Showing posts with label দারসুল কুরআন. Show all posts
Showing posts with label দারসুল কুরআন. Show all posts

সুরা মুনাফিকুন (৯-১১)

 আরবী ও অনুবাদঃ

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُلۡہِکُمۡ اَمۡوَالُکُمۡ وَ لَاۤ اَوۡلَادُکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ ۚ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ ﴿۹﴾

‘হে মুমিনগণ ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান–সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ উদাসীন হবে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।

وَ اَنۡفِقُوۡا مِنۡ مَّا رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ اَحَدَکُمُ الۡمَوۡتُ فَیَقُوۡلَ رَبِّ لَوۡ لَاۤ اَخَّرۡتَنِیۡۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ۙ فَاَصَّدَّقَ وَ اَکُنۡ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿۱۰﴾

আর আমরা তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তোমরা তা থেকে ব্যয় করবে। তোমাদের কারও মৃত্যু আসার আগে। (অন্যথায় মৃত্যু আসলে সে বলবে) ‘হে আমার রব ! আমাকে আরো কিছু কালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সাদাকাহ দিতাম ও সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত হতাম !

وَ لَنۡ یُّؤَخِّرَ اللّٰہُ نَفۡسًا اِذَا جَآءَ اَجَلُہَا ؕ وَ اللّٰہُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ {۱۱}

কিন্তু নির্ধারিত কাল যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কখনো কাউকেও অবকাশ দেবেন না। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত।


সুরা পরিচিতি:

সুরার নাম- মুনাফিকুন

সুরা নং- ৬৩

মোট আয়াত- ১১

মোট টিকা- ১৮ (তাফহীম)

রুকু- ২

পারা- ২৮

অবতীর্ণ- মদিনা

পূর্ববর্তী সুরা- জুমুয়া

পরবর্তী সুরা- তাগাবুন


নামকরণ: 

সুরার প্রথম আয়াতে اِذَا جَآءَكَ الۡمُنٰفِقُوۡنَ قَالُوۡا نَشۡهَدُ اِنَّكَ لَرَسُوۡلُ اللّٰهِ ۘ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ اِنَّكَ لَرَسُوۡلُهٗ ؕ وَ اللّٰهُ یَشۡهَدُ اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَكٰذِبُوۡنَ

[যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তাঁর রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী]

এর إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ শব্দ থেকে এ সূরার নাম গ্রহণ করা হয়েছে 'মুনাফিকুন'। এটি এ সূরার নাম এবং বিষয়বস্তু শিরোনামও। কারণ এ সূরায় মুনাফিকদের কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করা হয়েছে।

*মুনাফিকের পরিচয়


আনুষাঙ্গিক বিষয়:

আল কুরআনে 'মুমিনুন' নামে সুরা আছে আবার 'কাফিরূন' নামে সুরা আছে।

এই দুইয়ের মাঝামাঝি ক্যাটাগরী 'মুনাফিকুন' নামে সুরা দেয়া হয়েছে।

এছাড়া ইসলামের বিপক্ষে অবস্থানকারী বিভিন্ন জাতিকে সম্বোধন করে কুরআন আয়াত নাযিল হয়েছে।

ইহুদি- ও ক্বলাতিল ইয়াহুদানা উজাইর ইবনুল্লাহ

নাসারা- ও ক্বলাতিন নাসারা মাসিহুব নুল্লাহ

ইহুদি ও মুশরিক- লাতা জিদান্না আশাদ্দান্নানি..

আহলে কিতাব- কুল ইয়া আহলাল কিতাবি...


নাযিল হওয়ার সময়কাল: 

বনী মুসতালিক যুদ্ধভিযান* থেকে রসূলুল্লাহ সা. এর ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে অথবা মদীনায় পৌছার অব্যবহিত পরে এ সূরা নাযিল হয়েছিল। 

৬ হিজরীর শা’বান মাসে বনী মুসতালিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল একথা আমরা সূরা নূরের ভূমিকায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বর্ণনা করেছি। এভাবে এর নাযিল হওয়ার সময় সঠিকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায়।


ঐতিহাসিক পটভূমি: 

-যে বিশেষ ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে এ সূরা নাযিল হয়েছিল তা আলোচনার পূর্বে মদীনার মুনাফিকদের ইতিহাসের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। 

-ঐ সময়ে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তা আদৌ কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা ছিল না। 

-তার পেছনে ছিল একটি পুরো ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ যা পরিশেষে এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। 


-পবিত্র মদীনা নগরীতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বে আওস ও খাযরাজ গোত্র দুটি পারস্পরিক গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। 

-তারা যথারীতি তাকে বাদশাহ বানিয়ে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু করেছিল। এমন কি তার জন্য রাজ মুকুটও তৈরী করা হয়েছিল। 

-এ ব্যক্তি ছিল খাযরাজ গোত্রের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল। 

-মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, খাযরাজ গোত্রে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সর্বসম্মত এবং আওস ও খাযরাজ ইতিপূর্বে আর কখনো একযাগে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। (ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৪, । 


-এই পরিস্থিতিতে ইসলামের বাণী মদীনায় পৌঁছে এবং এই দুটি গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে

-হিজরতের আগে আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতের সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন মদীনায় আগমনের জন্য আহবান জানানো হচ্ছিল তখন হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাদলা (রা.) আনসারী এ আহবান জানাতে শুধু এ কারণে দেরী করতে চাচ্ছিলেন যাতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও বাইয়াত ও দাওয়াতে শামিল হয় এবং এভাবে মদীনা যেন সর্বসম্মতিক্রমে ইসলামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। 

-কিন্তু যে প্রতিনিধি দল বাইয়াতের জন্য হাজির হয়েছিল তারা এই যুক্তি ও কৌশলকে কোন গুরুত্বই দিলেন না এবং এতে অংশগ্রহণকারী দুই গোত্রের ৭৫ ব্যক্তি সব রকম বিপদ মাথা পেতে নিয়ে নবী (সা.) কে দাওয়াত দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল। (ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৯) 


-এরপর নবী (সা.) যখন মদীনায় পৌছলেন তখন আনসারদের ঘরে ঘরে ইসলাম এতটা প্রসার লাভ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিরূপায় হয়ে পড়েছিল। 

-নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য তার নিজের জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই সে তার বহু সংখ্যক সহযোগী ও সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। 

-এদের মধ্যে উভয় গোত্রের প্রবীণ ও নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকেরা ছিল। অথচ তাদের সবার অন্তর জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অন্তর্জ্বালা ও দু:খ ছিল অত্যন্ত তীব্র। 

-কারণ সে মনে করতো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রাজত্ব ও বাদশাহী ছিনিয়ে নিয়েছেন। 

-তার এই মুনাফেকীপূর্ণ ঈমান এবং নেতৃত্ব হারানোর দু:খ কয়েক বছর ধরে বিচিত্র ভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে থাকল। 

-একদিকে তার অবস্থা ছিল এই যে, প্রতি জুমআর দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বরে উঠে বসতেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উঠে বলতো, “ভাইসব, আল্লাহর রসূল আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর কারণে আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। তাই আপনারা সবাই তাঁকে সাহায্য, সহযোগিতা করুন। এবং তিনি যা বলেন গভীর মনযোগ সহকারে শুনুন এবং তার আনুগত্য করুন। “(ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা, ১১১, । 

-অপরদিকে অবস্থা ছিল এই যে, প্রতিদিনই তার মুনাফেকীর মুখোশ খুলে পড়ছিল এবং সৎ ও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, সে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইসলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা পোষণ করে। 


-একবার নবী (সা.) কোন এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় পথে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর সাথে অভদ্র আচরণ করে। তিনি হযরত সা’দ ইবনে উবাদাকে বিষয়টি জানালে সা’দ বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, আপনি এ ব্যক্তির প্রতি একটু নম্রতা দেখান। আপনার আগমনের পূর্বে আমরা তার জন্য রাজমুকুট তৈরী করেছিলাম। এখন সে মনে করে, আপনি তার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। “(ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৩৭, ২৩৮, । 


-বদর যুদ্ধের পর বনী কাইনুকা গোত্রের ইহুদীরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও অকারণে বিদ্রোহ করলে রসূলুল্লাহ (সা.) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। 

-তখন এই ব্যক্তি তাদের সমর্থনে কোমর বেঁধে কাজ শুরু করে। সে নবীর (সা.) বর্ম ধরে বলতে লাগলো, এই গোত্রটির সাতশত বীরপুরুষ যোদ্ধা শত্রুর মোকাবেলায় সবসময় আমাকে সাহায্য করেছে।

-আজ একদিনেই আপনি তাদের হত্যা করতে যাচ্ছেন? আল্লাহর শপথ, আপনি যতক্ষণ আমার এই মিত্রদের ক্ষমা না করবেন আমি ততক্ষণ আপনাকে ছাড়বো না। (ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১-৫২, । 


-উহুদ যুদ্ধের সময় এই ব্যক্তি খোলাখুলি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে সে তার তিনশত সঙ্গী-সাথীকে নিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসেছে। 

-কি সাংঘাতিক নাজুক মুহূর্তে সে এই আচরণ করেছে তা এই একটি বিষয় থেকেই অনুমান করা যায় যে, কুরাইশরা তিন হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে মদীনার ওপরে চড়াও হয়েছিল আর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র এক হাজার লোক নিয়ে তাদের মোকাবিলা ও প্রতিরোধের জন্য বেরিয়েছিলেন। -এক হাজার লোকের মধ্যে থেকেও এই মুনাফিক তিনশত লোককে আলাদা করে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল এবং নবী (সা.) কে শুধু সাতশত লোকের একটি বাহিনী নিয়ে তিন হাজার শত্রুর মোকাবিলা করতে হলো। 


-এ ঘটনার পর মদীনার সব মুসলমান নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলো যে, এ লোকটি কট্টর মুনাফিক। 

-তার যেসব সংগী সাথী এই মুনাফিকীতে তার সাথে শরীক ছিল তাদেরকেও তারা চিনে নিল। এ কারণে উহুদ যুদ্ধের পর প্রথম জুম’আর দিনে নবীর (সা.) খোতবা দেয়ার পূর্বে এ ব্যক্তি যখন বক্তৃতা করতে দাঁড়ালো তখন লোকজন তার জামা টেনে ধরে বলল: “তুমি বসো, তুমি একথা বলার উপযুক্ত নও।” 

-মদীনাতে এই প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে এ ব্যক্তিকে অপমানিত করা হলো। এতে সে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হলো এবং মানুষের ঘাড় ও মাথার উপর দিয়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। 

-মসজিদের দরজার কাছে কিছু সংখ্যক আনসার তাকে বললেন, “তুমি একি আচরণ করছো? ফিরে চলো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করো।” 

-এতে সে ক্রোধে ফেটে পড়লো এবং বললো! “তাকে দিয়ে আমি কোন প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা করাতে চাই না”। (ইবনে হিশাম, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১১, । 


-হিজরী ৪ সনে বনু নাযীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সময় এই ব্যক্তি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আরো খোলাখুলিভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের সাহায্য সহযোগিতা দান করে।

-একদিকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণ এসব ইহুদী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

-অপরদিকে এই মুনাফিকরা গোপনে গোপনে ইহুদীদের কাছে খবর পাঠাচ্ছিল যে, তোমরা রুখে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের সাথে আছি।

-তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো এবং তোমাদেরকে বহিষ্কার করা হলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব। 

-আল্লাহ তা’আলা তাদের এই গোপন গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টি প্রকাশ করে দিলেন। সূরা হাশরের দ্বিতীয় রুকূ’তে এ বিষয়েই আলোচনা করা হয়েছে। 


-কিন্তু তার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মুখোশ খুলে পড়ার পরও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কার্যকলাপ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। 

-কারণ মুনাফিকদের একটা বড় দল তার সহযোগী ছিল। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের বহু সংখ্যক নেতা তার সাহায্যকারী ছিল। 

-কম করে হলেও মদীনার গোটা জনবসতির এক তৃতীয়াংশ ছিল তার সাঙ্গপাঙ্গ। উহুদ যুদ্ধের সময় এ বিষয়টিই প্রকাশ পেয়েছিল। 

-এই পরিস্থিতিতে বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ শত্রুর সাথেও যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়া কোন অবস্থায়ই সমীচীন ছিল না। 

-এ কারণে তাদের মুনাফিকী সম্পর্কের অবহিত থাকা সত্ত্বেও নবী (সা.) দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাহ্যিকভাবে ঈমানের দাবি অনুসারেই তাদের সাথে আচরণ করেছেন। 

-অপরদিকে এসব লোকেরও এতটা শক্তি ও সাহস ছিল না যে, তারা প্রকাশ্যে কাফের হয়ে ঈমানদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করত অথবা খোলাখুলি কোন হামলাকারী শত্রুর সাথে মিলিত হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতো। 

-বাহ্যত তারা নিজেদের একটা মজবুত গোষ্ঠী তৈরী করে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বহু দুর্বলতা সূরা হাশরের ১২ থেকে ১৪ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে সেইসব দুর্বলতার কথাই তুলে ধরেছেন। 

-তাই তারা মনে করতো মুসলমান সেজে থাকার মধ্যেই তাদের কল্যাণ নিহিত। তারা মসজিদে আসত, নামায পড়তো এবং যাকাতও দিতো। 

-তাছাড়া মুখে ঈমানের লম্বা চওড়া দাবি করতো, সত্যিকার মুসলমানদের যা করার আদৌ কোন প্রয়োজন পড়তো না। 

-নিজেদের প্রতিটি মুনাফিকী আচরণের পক্ষে হাজারটা মিথ্যা যুক্তি তাদের কাছে ছিল। এসব কাজ দ্বারা তারা নিজেদের স্বগোত্রীয় আনসারদেরকে এই মর্মে মিথ্যা আশ্বাস দিত যে, আমরা তোমাদের সাথেই আছি। 

-আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তাদের অনেক ক্ষতি হতো। এসব কৌশল অবলম্বন করে তারা যেসব ক্ষতি থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিল। 

-তাছাড়া তাদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থেকে মুসলমানদের ভেতরে কলহ কোন্দল ও ফ্যাসাদ সৃষ্টির এমন সব সুযোগও তারা কাজে লাগাচ্ছিল যা অন্য কোন জায়গায় থেকে লাভ করতে পারত না। 


-এসব কারণে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ মুনাফিকরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বনী মুসতালিক যুদ্ধাভিযানে শরীক হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল এবং এই সুযোগে একই সাথে এমন দুটি মহাফিতনা সৃষ্টি করেছিল যা মুসলমানদের সংহতি ও ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারত। 

-কিন্তু পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সাহচর্য থেকে ঈমানদাগণ যে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তার কল্যাণে যথা সময়ে এ ফিতনার মুলোৎপাটন হয়ে যায় এবং এসব মুনাফিক নিজেরাই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। 

-এ দুটি ফিতনার মধ্যে একটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা নূরে। আর অপর ফিতনাটির উল্লেখ করা হয়েছে আলোচ্য এই সূরাটিতে। 


সুরার বিষয়বস্তু:

১. মুনাফিক ও তাদের আচরণ।

২. তারা রাসুল সা. এর কাছে দু'আ প্রার্থী নয়।

৩. দুনিয়ার মোহে না পড়ার আহবান।

৪. মৃত্যুর পূর্বেই বেশি বেশি দান করা।


ব্যাখ্যা:

৯নং আয়াত: "ধন সম্পদ ও সন্তানাদির মোহে পড়ে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া, এরূপ ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্থ"

-জুইয়িনা লিন্নাসি হুব্বুশ শাহাওয়াতি....(আলে ইমরান: ১৪)

-কুল ইন কানা আবায়ুকুম...(তাওবা: ২৪)

-ইন্না মিন আজওয়াজিকুম ও আওলাদিকুম আদুয়াল লাকুম ফাহজারুহুম (তাগাবুন: ১৪)

[তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু, তাদের ব্যাপারে সতর্ক হও]

-ই'লামু আন্নামাল হায়াতিদ দুনিয়া..(হাদীদ: ২০)

-ও আনজির আশিরাতাকাল আকরাবিন

-রাব্বানা আরিনাল লাদাইনি আদাল্লানা...

-ধনী ব্যক্তিদের অজুহাতের মোকাবিলায় আল্লাহ সুলাইমান আ. কে পেশ করবেন

-আল মালু ওল বানু জিনাতুন হায়াতিদ দুনিয়া

-ইয়াওমা লা ইয়ান ফায়ু মালু ওলা বানু...

-ওমাল আকসারুনা আমওয়ালা (হাদিস)

-আল হাকুমুত তাকাসুর...(তাকাসুর: ১-২)

-যত বড় ব্যবসায়ী তত আন্দোলন থেকে পিছিয়ে

-সন্তানের মোহে পড়ে তাদেরকে আন্দোলনের পথে আসতে দেয় না

-সন্তানের ব্যাপারে পরীক্ষা দিতে হবে ইব্রাহিম আ: এর মত


১০নং আয়াত: "মৃত্যু আসার আগেই দান সাদকা করো, না হয় তোমরা আফসোস করবে আর আল্লাহ কাছে সাদকা ও নেক আমল করার জন্য অবকাশ চাইবে"

-আল্লাযিনা ইয়ানফিকুনা ফিস সাররাহি ওদ দাররাহি (আলে ইমরান: ১৩৪)

-রিযিক থেকে দান করতে হবে (বাকারা:৩)

-বেলাল, আবু বকর আর ওসমানের দান

-ও তুজাহিদুনা ফি সাবিল্লাহি বি আমওয়া লিকুম ও আনফুসিকুম

-ইয়া লাইতানি কুনতু তুরাবা (নাবা:৪০)

-ইয়াকুলু ইয়া লাইতানি কদ্দামতু লি হায়াতিহি (ফজর: ২৪)

-আল বাহারু আরবায়া, মওত/আমান, হায়াত/মাওয়া, মাওয়া/জুনুব, আল কবরু বাহারুন নাদামা (ওমর রা.)


১১নং আয়াত: "মৃত্যু যখন আসবে কাউকে আর অবকাশ দেয়া হবে না আর তোমাদের কাজ সম্পর্কে আল্লাহ অবহিত"

-ফাইযা জায়া আজালুহুম...(নাহল:৬১)

-ফা ইযা জায়া আজালুহুম লা ইয়াস তাখিরুনা সায়াতাও ওলা ইয়াস তাকদিমুন (আরাফ: ৩৪)

-কাল্লা ইযা বালাগাতিত তারাকিয়া ওকিলা মান রাক (কিয়ামাহ: ২৬-৩০)

-স্ত্রীর ক্রন্দন, সন্তানের আহাজারি মওতের বধির কর্ণে কোন আওয়াজ পৌঁছে না

-ইকতারাবা লিন্নাসি হিসাবুহুম...(আম্বিয়া:১)

-আকসিরুজ জিকরি হাজিমিল লাজ্জাতিল মাওত (আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত হাদিস)

-Death keeps no calendar 

-কাম তারাকু মিন জান্নাতিন ও উয়ুন, ও জুরুইন ও মাকামিন কারীম, ও না'মাতি কানু ফিহা ফাকিহিন, কাজালিকা ও আওরাস নাহা কাওমান আখারীন (দুখান: ২৫-২৮)

সুরা নিসা (আয়াতঃ ৭১-৭৬)

সুরা পরিচিতিঃ

সুরার নাম- আন নিসা (سورة النساء)

সুরার অর্থ- মহিলা

সুরা নম্বর- ৪ (চতুর্থ)

আয়াত সংখ্যা- ১৭৬টি 

রুকুর সংখ্যা- ২৪টি

পারা- ৪ থেকে ৬

অবতীর্ণ- মদিনা

পূর্ববর্তী সুরা- আলে ইমরান

পরবর্তী সুরা- মায়েদা


নামকরণঃ

এই সুরার বিভিন্ন আয়াতে মোট ১৬ বার "নিসা" শব্দটি রয়েছে। যেমন:

১ নং আয়াতে, 'ও বাসসা মিন হুমার রিজালান কাসিরাও ও নিসায়া'

৩ নং আয়াতে, 'ফানকিহু মা ত্ববালাকুম মিনান নিসা'

৪ নং আয়াতে, 'ও আতুন নিসায়া সুদুকাতিহিন্না নিজলাহ'

৩৪ নং আয়তে, 'আর রিজালুন কাওয়ামুনা আলান নিসা'

৭৫ নং আয়াতে, 'ওল মুসতাদ আফিনা মিনার রিজালি ওন নিসা'

কুরআনের অন্যান্য সুরাতেও 'নিসা' শব্দটি রয়েছে-

আলে ইমরানের ১৪ নং আয়াতে, 'হুব্বুশ শাহাওয়াতি মিনান নিসা'

সেই হিসেবে সুরার নাম দেয়া হয়েছে 'আন নিসা' যার অর্থ মহিলা/নারী/স্ত্রীলোক/রমনী/Female/Women/Lady 

[নারী সম্পর্কে কিছু কথা]

কুরআনে এর কাছাকাছি ব্যবহৃত শব্দরূপ- 

✔ 'ইমরাত' 

ও দারাবাল্লাহু মাসালান লিল্লাযিনা আমানু ইমরাতা* ফিরআউন [সুরা তাহরিম:১১] 

✔ 'ইনাসা' 

ইয়া হাবু লি মাইয়াশায়ু ইনাসাও* ও ইয়া হাবু লি মাইয়াশায়ু জুকুরা, আও ইয়ু যাও ইজুহুম জুকরাও ও ইনাসাও* ও ইয়াজয়ালু মাইয়াশায়ু আকিমা [সুরা শূরা: ৪৯-৫০]

✔ 'জাওজ'

ইয়া আদম উসকুন আনতা ও জাওজুকাল* জান্নাতা [বাকারা: ৩৫]

রাব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা* ওয়া জুররিয়া তিনা কুররাতা আইয়ুন [ফুরকান: ৭৪]


আনুষাঙ্গিক বিষয়ঃ

এই সুরা শুরু হয়েছে 'ইয়া আইয়ুহান নাস' দিয়ে।

এই শব্দ দিয়ে কুরআনে আরো একটি সুরা শুরু হয়েছে। ২২ নং সুরা হাজ্জ্ব।


নাযিল হওয়ার সময়কালঃ

এ সূরাটি কয়েকটি ভাষণের সমষ্টি। সম্ভবত তৃতীয় হিজরীর শেষের দিক থেকে নিয়ে চতুর্থ হিজরীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম হিজরীর প্রথম দিকের সময়-কালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন অংশ নাযিল হয়। 


আমরা জানি উত্তরাধিকার বন্টন ও এতিমদের অধিকার সম্বলিত বিধানসমূহ ওহোদ যুদ্ধের পর নাযিল হয়। তখন সত্তর জন মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনাটির ফলে মদীনার ছোট জনবসতির বিভিন্ন গৃহে শহীদদের মীরাস কিভাবে বন্টন করা হবে এবং তারা যেসব এতিম ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন তাদের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরই ভিত্তিতে আমরা অনুমান করতে পারি, প্রথম চারটি রুকু, ও পঞ্চম রুকূর প্রথম তিনটি আয়াত এ সময় নাযিল হয়ে থাকবে।


যাতুর রিকা'র যুদ্ধে সালাতুল খওফ (যুদ্ধ চলা অবস্থায় নামায পড়া) পড়ার রেওয়ায়াত আমরা হাদীসে পাই। এ যুদ্ধটি চতুর্থ হিজরীতে সংঘটিত হয়। তাই এখানে অনুমান করা যেতে পারে, যে ভাষণে (১৫ রুকূ) এ নামাযের নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে সেটি এরই কাছাকাছি সময়ে নাযিল হয়ে থাকবে। 


চতুর্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মদীনা থেকে বনী নযীরকে বহিষ্কার করা হয়। তাই যে ভাষণটিতে ইহুদীদেরকে এ মর্মে সর্বশেষ সর্তকবাণী শুনিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, আমি তোমাদের চেহারা বিকৃত করে পেছন দিকে ফিরিয়ে দেবার আগে ঈমান আনো, সেটি এর পূর্বে কোন নিকটতম সময়ে নাযিল হয়েছিল বলে শক্তিশালী অনুমান করা যেতে পারে।


বনী মুসতালিকের যুদ্ধের সময় পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর এ যুদ্ধটি পঞ্চম হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল। তাই যে ভাষণটিতে (৭ম রুকু) তায়াম্মুমের কথা উল্লেখিত হয়েছিল সেটি এ সময়ই নাযিল হয়েছিল মনে করতে হবে।


নাযিলের উপলক্ষ/প্রেক্ষাপটঃ

এভাবে সামগ্রিক পর্যায়ে সূরাটি নাযিল হওয়ার সময়-কাল জানার পর আমাদের সেই যুগের ইতিহাসের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়া উচিত। এর সাহায্যে সূরাটি আলোচ্য বিষয় অনুধাবন করা সহজসাধ্য হবে।


নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে সে সময় যেসব কাজ ছিল সেগুলোকে তিনটি বড় বড় বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। 

১. একটি নতুন ইসলামী সমাজ সংগঠনের বিকাশ সাধন। হিজরতের পরপরই মদীনা ও তার আশেপাশের এলাকায় এ সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের পুরাতন পদ্ধতি নির্মূল করে নৈতিকতা, তামাদ্দুন, সমাজরীতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা নতুন নীতি-নিয়ম প্রচলনের কর্মতৎপরতা এগিয়ে চলছিল। 

২. আরবের মুশরিক সম্প্রদায়, ইহুদী গোত্রসমূহ ও মুনাফিকদের সংস্কার বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে ইসলামের যে ঘোরতর সংঘাত চলে আসছিল তা জারী রাখা। 

৩. এ বিরোধী শক্তিগুলোর সকল বাধা উপেক্ষা করে ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকা এবং এ জন্য আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সেখানে ইসলামকে বিজয়ীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করা।


আলোচ্য বিষয়ঃ

ইসলামের সামাজিক কাঠামো নির্মাণ এবং বাস্তবে এ সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম অবস্থায় যে সমস্ত নির্দেশ ও বিধানের প্রয়োজন ছিল সূরা বাকারায় সেগুলো প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমানে এ সমাজ আগের চাইতে বেশী সম্প্রসারিত হয়েছে। কাজেই এখানে আরো নতুন নতুন বিধান ও নির্দেশের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। 


১. পরিবার গঠনের নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। বিয়েকে বিধি-নিষেধের আওতাধীন করা হয়েছে। 

২. সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। 

৩. এতিমদের অধিকার নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মীরাস বন্টনের নিয়ম-কানুন নির্ধারিত হয়েছে। 

৪. অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

৫. ঘরোয়া বিবাদ মিটাবার পদ্ধতি শিখানো হয়েছে। 

৬. অপরাধ দণ্ডবিধির ভিত গড়ে তোলা হয়েছে। 

৭. মদপানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। 

৮. তাহারাত ও পাক-পবিত্রতা অর্জনের বিধান দেয়া হয়েছে। 

৯. আল্লাহ ও বান্দার সাথে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষের কর্মধারা কেমন হতে পারে, তা মুসলমানদের জানানো হয়েছে। 

১০. মুসলমানদের মধ্যে দলীল সংগঠন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে। 

১১. আহলি কিতাবদের নৈতিক, ধর্মীয় মনোভাব ও কর্মনীতি বিশ্লেষণ করে মুসলমানদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন পূর্ববর্তী উম্মতদের পদাংক অনুসরণ করে চলা থেকে বিরত থাকে। 

১২. মুনাফিকদের কর্মনীতির সমালোচনা করে যথার্থ ও খাঁটি ঈমানদারীর এবং ঈমান ও নিফাকের পার্থক্য সূচক চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে রেখে দেয়া হয়েছে। 

১৩. ইসলাম বিরোধী শক্তিদের সাথে যে সংঘাত চলছিল ওহোদ যুদ্ধের পর তা আরো নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল। ওহোদের পরাজয় আশপাশের মুশরিক গোত্রসমূহ, ইহুদী প্রতিবেশীবৃন্দ ও ঘরের শক্র বিভীষণ তথা মুনাফিকদের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলমানরা সবদিক থেকে বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিকে আবেগময় ভাষণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করলেন এবং অন্যদিকে যুদ্ধাবস্থায় কাজ করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। 

১৪. মদীনায় মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার লোকেরা সব ধরনের ভীতি ও আশংকার খবর ছড়িয়ে হতাশা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। এ ধরনের প্রত্যেকটি খবর দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার এবং কোন খবর সম্পর্কে পুরোপুরি অনুসন্ধান না করার আগে তা প্রচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার নির্দেশ দেয়া হয়।

১৫. মুসলমানদের বারবার যুদ্ধে ও নৈশ অভিযানে যেতে হতো। অধিকাংশ সময় তাদের এমন সব পথ অতিক্রম করতে হতো যেখানে পানির চিহ্নমাত্রও পাওয়া যেতো না। সে ক্ষেত্রে পানি না পাওয়া গেলে অযু ও গোসল দুয়ের জন্য তাদের তায়াম্মুম করার অনুমতি দেয়া হয়। 

১৬. এছাড়াও এ অবস্থায় সেখানে নামায সংক্ষেপে করারও অনুমতি দেয়া হয়। 

১৭. আর যেখানে বিপদ মাথার ওপর চেপে থাকে সেখানে সালাতুল খওফ (ভয়কালীন নামায) পড়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়। 

১৮. আরবের বিভিন্ন এলাকায় যেসব মুসলমান কাফের গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং অনেক সময় যুদ্ধের কবলেও পড়ে যেতো, তাদের ব্যাপারটি ছিল মুসলমানদের জন্য অনেক বেশী পেরেশানির কারণ। এ ব্যাপারে একদিকে ইসলামী দলকে বিস্তারিত নির্দেশ দেয়া হয় এবং অন্যদিকে ঐ মুসলমানদেরকেও সবদিক থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে সমবেত হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

১৯. ইহুদীদের মধ্যে বিশেষ করে বনী নাযীরের মনোভাব ও কার্যধারা অত্যন্ত বিরোধমূলক ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তারা সব রকমের চুক্তির খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণ করে ইসলামের শক্রদের সাথে সহযোগিতা করতে থাকে এবং মদীনায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে। তাদের এসব কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরকে সর্বশেষ সতর্কবাণী শুনিয়ে দেয়া হয় এবং এরপরই মদীনা থেকে তাদের বহিষ্কারের কাজটি সমাধা করা হয়।

২০. মুনাফিকদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে। কোন ধরনের মুনাফিকদের সাথে কোন ধরনের ব্যবহার করা হবে, এ সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাই এদের সবাইকে আলাদা আলাদা শ্রেণীতে বিভক্ত করে প্রত্যেক শ্রেণীর মুনাফিকদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তা বলে দেয়া হয়েছে। 

২১. চুক্তিবদ্ধ নিরপেক্ষ গোত্রসমূহের সাথে মুসলমানদের কোন ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তাও সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। 

২২. মুসলমানদের নিজেদের চরিত্রকে ত্রুটিমুক্ত করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এ সংঘাত সংঘর্ষে এ ক্ষুদ্র দলটি একমাত্র নিজের উন্নত নৈতিক চরিত্র বলেই জয়লাভ করতে সক্ষম ছিল। এছাড়া তার জন্য জয়লাভের আর কোন উপায় ছিল না। তাই মুসলমানদেরকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। 

২৩. তাদের দলের মধ্যে যে কোন দুর্বলতা দেখা দিয়েছে কঠোর ভাষায় তার সমালোচনা করা হয়েছে।

২৪. ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের দিকটিও এ সূরায় বাদ যায়নি। জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় ইসলাম দুনিয়াকে যে নৈতিক ও তামাদ্দুনিক সংশোধনের দিকে আহবান জানিয়ে আসছিল, তাকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করার সাথে সাথে এ সূরায় ইহুদী, খৃস্টান ও মুশরিক এ তিনটি সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণা-বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তাদের সামনে একমাত্র সত্য দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়েছে।


নির্ধারিত অংশের ব্যাখ্যাঃ

আয়াত নং :-৭১

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا خُذُوْا حِذْرَكُمْ فَانْفِرُوْا ثُبَاتٍ اَوِ انْفِرُوْا جَمِیْعًا

হে ঈমানদারগণ! মোকাবিলা করার জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকো।(১০১) তারপর সুযোগ পেলে পৃথক পৃথক বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে বের হয়ে পড়ো অথবা এক সাথে।


টিকা:১০১) উল্লেখ্য এ ভাষণটি এমন এক সময় নাযিল হয়েছিল যখন ওহোদ যুদ্ধের পরাজয়ের পর মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকার গোত্রগুলোর সাহস বেড়ে গিয়েছিল এবং বিপদ আপদ চতুর্দিক থেকে মুসলমানদেরকে ঘিরে ফেলেছিল। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই নানান ধরনের দুঃসংবাদ আসতো। উমুক গোত্র বিরূপ হয়ে গেছে। মুসলমানদের সাথে এক নাগাড়ে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছিল। তাদের প্রচারকদেরকে দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে দাওয়াত দিয়ে ধোঁকা দিয়ে হত্যা করা হতো। মদীনার বাইরে তাদের জানমালের কোন নিরাপত্তা ছিল না। এ অবস্থায় এসব বিপদের ঢেউয়ের আঘাতে যাতে ইসলামের তরী ডুবে না যায় সেজন্য মুসলমানদের পক্ষ থেকে একটি জোরদার প্রচেষ্টা ও জীবন উৎসর্গকারী সংগ্রাম পরিচালনার প্রয়োজন ছিল।


আয়াত নং :-৭২

وَ اِنَّ مِنْكُمْ لَمَنْ لَّیُبَطِّئَنَّ ۚ فَاِنْ اَصَابَتْكُمْ مُّصِیْبَةٌ قَالَ قَدْ اَنْعَمَ اللّٰهُ عَلَیَّ اِذْ لَمْ اَكُنْ مَّعَهُمْ شَهِیْدًا

হ্যাঁ, তোমাদের কেউ কেউ এমনও আছে যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে গড়িমসি করে।(১০২) যদি তোমাদের ওপর কোন মুসিবত এসে পড়ে তাহলে সে বলে আল্লাহ‌ আমার প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করেছেন, আমি তাদের সাথে যাইনি।


টিকা:১০২) এর এক অর্থ এও হতে পারে যে, নিজে তো গড়িমসি করেই, এমন কি অন্যদেরকেও হিম্মতহারা করে দেয়, তাদের বুকে ভয় ঢুকিয়ে দেয় এবং জিহাদ বন্ধ করার জন্য এমন ধরনের কথা বলতে থাকে যার ফলে তারা নিজেদের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকে।


আয়াত নং:- ৭৩

وَ لَئِنْ اَصَابَكُمْ فَضْلٌ مِّنَ اللّٰهِ لَیَقُوْلَنَّ كَاَنْ لَّمْ تَكُن ۢ ْ بَیْنَكُمْ وَ بَیْنَهٗ مَوَدَّةٌ یّٰلَیْتَنِیْ كُنْتُ مَعَهُمْ فَاَفُوْزَ فَوْزًا عَظِیْمًا

আর যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়, তাহলে সে বলে—এবং এমনভাবে বলে যেন তোমাদের ও তার মধ্যে কোন প্রীতির সম্পর্ক ছিলই না,-হায়! যদি আমিও তাদের সাথে হতাম তাহলে বিরাট সাফল্য লাভ করতাম।


আয়াত নং :-৭৪

فَلْیُقَاتِلْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ الَّذِیْنَ یَشْرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا بِالْاٰخِرَةِ ؕ وَ مَنْ یُّقَاتِلْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ فَیُقْتَلْ اَوْ یَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِیْهِ اَجْرًا عَظِیْمًا

(এই ধরনের লোকদের জানা উচিত) আল্লাহর পথে তাদের লড়াই করা উচিত যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিকিয়ে দেয়।(১০৩) তারপর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়বে এবং মারা যাবে অথবা বিজয়ী হবে তাকে নিশ্চয়ই আমি মহাপুরস্কার দান করবো।


টিকা:১০৩) অর্থাৎ আল্লাহর পথে লড়াই করা দুনিয়ার লাভ ও দুনিয়ার স্বার্থ পূজারী লোকদের কাজ নয়। এটা এমন এক ধরনের লোকের কাজ যারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করে, যারা আল্লাহ‌ ও আখেরাতের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখে এবং নিজেদের পার্থিব প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির সমস্ত সম্ভাবনা ও সব ধরনের পার্থিব স্বার্থ একমাত্র আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তাদের রব যেন তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং এই দুনিয়ায় তাদের ত্যাগ কুরবানী বিফল হয়ে গেলেও আখেরাতেও যেন বিফলে না যায়।


আয়াত নং :-৭৫

وَ مَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ الْمُسْتَضْعَفِیْنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الْوِلْدَانِ الَّذِیْنَ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا مِنْ هٰذِهِ الْقَرْیَةِ الظَّالِمِ اَهْلُهَا ۚ وَ اجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ وَلِیًّا ۙ ۚ وَّ اجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ نَصِیْرًاؕ 

তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও।(১০৪)


টিকা:১০৪) এখানে এমন সব মজলুম শিশু, নারী ও পুরুষদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা মক্কায় ও আরবের অন্যান্য গোত্রের মধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তাদের হিজরত করার শক্তি ছিল না এবং নিজেদেরকে কাফেরদের জুলুম-নির্যাতন থেকে রক্ষা করার ক্ষমতাও ছিল না। এদের ওপর বিভিন্ন প্রকার জুলুম চালানো হচ্ছিল। কেউ এসে তাদেরকে এই জুলুমের সাগর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে, এই ছিল তাদের দোয়া ও প্রত্যাশা।


আয়াত নং :-৭৬

اَلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ ۚ وَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ الطَّاغُوْتِ فَقَاتِلُوْۤا اَوْلِیَآءَ الشَّیْطٰنِ ۚ اِنَّ كَیْدَ الشَّیْطٰنِ كَانَ ضَعِیْفًا۠

যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে।(১০৫) কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ো এবং নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের কৌশল আসলে নিতান্তই দুর্বল।(১০৬)


টিকা:১০৫) এটি আল্লাহর একটি দ্ব্যর্থহীন ফায়সালা। আল্লাহর পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে লড়াই করা হচ্ছে ঈমানদারদের কাজ। যথার্থ ও সত্যিকার মু’মিন এই কাজ থেকে কখনো বিরত থাকবে না। আর আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহ বিরোধী ও আল্লাহদ্রোহীদের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাগুতের পথে লড়াই করা হচ্ছে কাফেরদের কাজ। কোন ঈমানদার ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে না।


টিকা:১০৬) অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে শয়তান ও তার সাথীরা বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসে এবং জবরদস্ত কৌশল অবলম্বন করে কিন্তু তাদের প্রস্তুতি ও কৌশল দেখে ঈমানদারদের ভীত হওয়া উচিত নয়, অবশ্যি তাদের সকল প্রস্তুতি ও কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।


সুরা বাকারা (আয়াত: ১৮৩-১৮৫)

 


আরবী ও অনুবাদঃ
 یٰۤاَیُّهَا الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا كُتِبَ عَلَيۡکُمُ الصِّيَامُ کَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِيۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُوۡنَۙ‏ ١٨٣
(১৮৩) হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের আগের লোকেদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।
اَيَّامًا مَّعۡدُوۡدٰتٍؕ فَمَنۡ كَانَ مِنۡكُمۡ مَّرِيۡضًا اَوۡ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنۡ اَيَّامٍ اُخَرَ​ؕ وَعَلَى الَّذِيۡنَ يُطِيۡقُوۡنَهٗ فِدۡيَةٌ طَعَامُ مِسۡكِيۡنٍؕ فَمَنۡ تَطَوَّعَ خَيۡرًا فَهُوَ خَيۡرٌ لَّهٗ ؕ وَاَنۡ تَصُوۡمُوۡا خَيۡرٌ لَّـکُمۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ‏ ١٨٤
(১৮৪) (রোযা) নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য, অতঃপর তোমাদের মধ্যে যে পীড়িত কিংবা মুসাফির সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করে নেবে এবং শক্তিহীনদের উপর কর্তব্য হচ্ছে ফিদইয়া প্রদান করা, এটা একজন মিসকীনকে অন্নদান করা এবং যে ব্যক্তি নিজের খুশীতে সৎ কাজ করতে ইচ্ছুক, তার পক্ষে তা আরও উত্তম আর সে অবস্থায় রোযা পালন করাই তোমাদের পক্ষে উত্তম, যদি তোমরা বুঝ।
شَهۡرُ رَمَضَانَ الَّذِىۡٓ اُنۡزِلَ فِيۡهِ الۡقُرۡاٰنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَ بَيِّنٰتٍ مِّنَ الۡهُدٰى وَالۡفُرۡقَانِۚ فَمَنۡ شَهِدَ مِنۡكُمُ الشَّهۡرَ فَلۡيَـصُمۡهُ ؕ وَمَنۡ کَانَ مَرِيۡضًا اَوۡ عَلٰى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنۡ اَيَّامٍ اُخَرَؕ يُرِيۡدُ اللّٰهُ بِکُمُ الۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ وَلِتُکۡمِلُوا الۡعِدَّةَ وَلِتُکَبِّرُوا اللّٰهَ عَلٰى مَا هَدٰٮكُمۡ وَلَعَلَّکُمۡ تَشۡكُرُوۡنَ‏ ١٨٥
(১৮৫) রমাযান মাস- যার মধ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে লোকেদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে, কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোযা পালন করে আর যে পীড়িত কিংবা সফরে আছে, সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা কষ্টদায়ক তা চান না যেন তোমরা মেয়াদ পূর্ণ করতে পার, আর তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর, আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।

সুরা পরিচিতিঃ

সুরা নং- ০২

মোট আয়াত- ২৮৬

মোট রুকু- ৪০

পারা- ১, ২, ৩

অবতীর্ণ- মদিনা

কুরআনের সবচেয়ে বেশি আয়াত বিশিষ্ট সুরা।

নামকরণঃ

এই সুরার ৬৭-৭১ নং আয়াতে বনী ইসরাঈলের গাভী জবাই সংক্রান্ত ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা ‘বাকারাহ’ শব্দের ব্যবহার করেছেন।

اِنَّ اللّٰهَ یَاۡمُرُکُمۡ اَنۡ تَذۡبَحُوۡا بَقَرَۃً 

এই আয়াতাংশের ‘বাকারা’ শব্দ থেকে সুরার নামকরণ করা হয়েছে বাকারাহ। যার অর্থ ‘গাভী’। সুরাটিতে নানান বিস্তারিত বিষয়ে আলোচনা আছে। আল্লাহ চাইলে সেই হিসেব করে একটু যথার্থ বিষয়বস্তু ঠিক করে সুরার নাম ঠিক করতে পারতেন। কিস্তু মানুষের বোধগম্যতার বিষয় বিবেচনা করে কুরআনের বেশিরভাগ সুরার নামকরণ নিচক শব্দ থেকে করা হয়েছে। এই সুরাটাও ঠিক তেমনই।

নাযিলের সময়কালঃ

সুরাটির বেশিরভাগ আয়াত রাসুল সা. এর মাদানী যুগের প্রথম দিকে নাযিল হয়েছে। অল্প কিছু আয়াত মাদানী যুগের শেষে নাযিল হয়েছে। যেমন: সুরার ২৭৫ নং আয়াতে সুদ হারাম ঘোষনার বিধানটি মাদানী যুগের শেষে নাযিল হয়। এছাড়া সুরার শেষ তিনটি আয়াত মক্কায় নাযিল হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর সামঞ্জাস্যতার কারনে আয়াতগুলোকে সুরা বাকারার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

প্রেক্ষাপট/ঐতিহাসিক পটভুমিঃ

সুরাটিতে চারটি মৌলিক বিষয়ের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে  বলে তাফহীমুল কুরআনের মুসান্নেফ উল্লেখ করেছেন।

১. রাসুল সা. হিযরতের পর মদিনা নামক ছোট্ট রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। মদিনার ইহুদিরা রাসুলের এই কাজে সমর্থন করেছেন। ইহুদিরা তখন থেকে প্রায় ১৯০০ বছর পূর্বে মুসা আ: এর কাছে নাযিলকৃত তাওরাতের খন্ডিত অংশ অনুসরণ করতেন। ফলে তাদের মধ্যে নানা বিকৃত বিষয়, কু-সংস্কার, অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তাদের সেই ভ্রান্ত আকীদার সমালোচনা করে এই সুরায় আয়াত নাযিল হয়েছে।

২. রাসুল সা. আহবানে সাড়া দিয়ে যারা একটি শাশ্বত বিধান ইসলামের দিকে দীক্ষিত হয়েছে তাদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার হিসেবে ইসলামের নির্দেশনা নাযিলের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এই সুরায় তাই জীবনবিধান হিসেবে ইসলামের সেই নির্দেশনাগুলোর এক ঝলক বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তীতে অন্যান্য সুরাগুলোতে এগুলোতে আরো বিস্তারিত আছে।

৩. হিযরতের পর মুসলমানদের গড়ে উঠা ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্রের বিরূদ্ধে শুরু হয়েছে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র। যার ফলশ্রুতিতে সেই সব ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করা তথা জিহাদের প্রস্তুতি নেয়া মুসলমানদের আবশ্যক হয়ে পড়েছে। তাই এই সুরার ২১৬ নং আয়াতে মুসলমানদের জিহাদের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

৪. মুসলমানদের মধ্যে কিছু মুনাফিক অনুপ্রবেশ করেছিল, যারা মুখে ঈমানের স্বীকৃতি দিলেও আসলে তারা ইসলামের বিরূদ্ধে কাজ করতো। তাই তাদের ব্যাপারেও সুরায় আলোচনা রয়েছে।

আয়াতভিত্তিক ব্যখ্যাঃ

১৮৩নং আয়াতঃ 

“কুতিবা আলাইকুমুস সিয়াম, কামা কুতিবা আলাল্লাযিনা মিন কাবলিকুম”

অর্থাৎ রোযা শুধু আমাদের জন্য নয়, পূর্ববর্তী নবী ও উম্মতদের উপরও ফরজ ছিল।

-বিভিন্ন তাফসীর থেকে তা জানা যায়। যেমনঃ -আদম আঃ এর যুগ থেকে রোযা ফরজ হয় (মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী: তাফসীরে ওসমানী)
-নুহ আঃ এর যুগে প্রতি মাসের ৩ দিন (১৩,১৪,১৫) রোযা ফরজ ছিল রোযা ফরজ ছিল (তাফসীর ইবনে কাসীর)
-মুসা আঃ এর যুগে ৪০ দিন (যিলক্বদ মাসের ৩০দিন+যিলহজ্জ মাসের ১০ দিন) রোযা ফরজ ছিল (তাফসীর ইবনে আব্বাস)
-ইব্রাহিম আঃ এর যুগে ৩০দিন রোযা রাখা হতো (তাফসীরে তাবারী)
-দাউদ আঃ এর যুগে ১দিন বাদে ১দিন রোযা ছিল (আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা.)
-ইদ্রিস আঃ সারা জীবন রোযা রেখেছেন (আল্লামা নিশাপুরী, গ্রন্থঃ আল আরাইশ)
– এমনকি এখনো ইহুদীরা বছরে একটি রোযা (আশুরা), খ্রিস্টানরা কয়েক ঘন্টার বিভিন্ন ধরণের রোযার সংস্কৃতি পালন করে, হিন্দুরাও উপোস পালন করে থাকে।

রমযানের রোযার তাৎপর্যঃ

এই মাস এতই গুরত্বপূর্ণ যে এই মাস আসার ২ মাস আগ থেকে রাসুল সঃ দোয়া করতেন। (আল্লাহুমা বারিকলানা ফি রজবা ও শাবান ওয়া বাল্লিগনা রমাদান)

-সালামান ফারসী রাঃ বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “ইয়া আইয়ুহান্নাস ক্বদ জাল্লাকুম মিন শাহারুন আজীম” (হে মানুষেরা তোমাদের জন্য এক মহান বুজুর্গ মাস আসছে)
– এই রমজানের বিশেষ ছাড় সম্পর্কে রাসুল সা. বলেন, ইযা কানা রমাদান ফাতাহাত আবওয়াবুর রহমাহ, ও খুল্লিকাত আবওয়াবু জাহান্নাম, ও ছুলছিলাতুশ শায়াতিন (এই সময় রহমাতে তথা জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়)

• এ মাসে রয়েছে তিনটি ভাগঃ রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত।
একটি কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য যেমনিভাবে কাপড় ভিজাতে হয়, সাবান/ডিটারজেন্ট দিয়ে ময়লা বের করা হয় এবং সর্বশেষ পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়।

তেমনি এই মাসের ১ম দশকে নিজের অন্তরকে আল্লাহ রহমতের পানিতে ভিজিয়ে, ২য় দশকে মাগফিরাত লাভের মাধ্যমে অন্তর থেকে গুনাহের ময়লা বের করে, ৩য় দশকের নাজাত লাভের মাধ্যমে নিজেকে গুনাহমুক্ত করার সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন।

- এ মাসে রোযা রাখার মাধ্যমে নফস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আসে।

-কারন নফসের গোলামেরা আল্লাহর গোলাম হতে পারে না (ও আম্মামান খাফা মাকামা রাব্বিহি ও নাহান নাফসা আনিল হাওয়া ফাইন্নাল জান্নাতা হিয়াল মাওয়া)
-মানুষের নফসের কুমন্ত্রণা গুনাহ বৃদ্ধি করে [হযরত ওমর বলেনঃ আন নাফসু হাওয়াহু বাহারুজ জুনুব (নফসের কুমন্ত্রণা গুনাহের সমুদ্র তৈরি করে)]
-নফসের কুমন্ত্রণা তিনটিঃ খাওয়া-দাওয়া, আরাম-আয়েশ, জৈবিক চাহিদা
(এ তিনটিই নিয়ন্ত্রণ হয় রোযা রাখার মাধ্যমে)
-মনোবিজ্ঞান বলে, কোন অভ্যাস ছাড়তে বা নতুন অভ্যাস তৈরি হতে ৩০ দিন লাগে। এজন্য রমজানের ৩০ দিনের কর্মপরিকল্পনা মাফিক কাজ বিশেষ গুরত্বপূর্ণ।

• এই মাসের প্রত্যেকটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ।
-রাসুল সা. বলেন, “ইন্নাল্লাহা ফারাদাত আলাইকুমুস সিয়াম ও জানানতু লাকুম কিয়ামা” (নিশ্চয় আল্লাহ রমজান মানে রোযা ফরজ করেছেন আর আমি তোমাদের রাতে কিয়ামুল লাইলের নির্দেশ দিচ্ছি)
-রাসুল আরো বলেন, “মান সমাহু ও কামাহু ঈমানাও ও ইহতেসাবা খারাজা মিন জুনুবি কাওয়ামি ওলাদাতহু উম্মুহু” (যারা এই মাসে সিয়াম ও কিয়াম ঈমান ও ইহতেসাব বা আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে পালন করে তাদেরকে আল্লাহ এভাবে গুনাহমুক্ত করে যেনো তারা সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর মত হয়ে যায়)
-একই বর্ণনা অন্য হাদিসে এসেছে এভাবে, “মান সমা রমজানা ঈমানাও ও ইহতেসাবান গোফারালাগু মা তাকাদ্দামা মিন জামবিক”
-এ মাসের একেকটি সুন্নত ফরজের সমান, একেকটি ফরজ ৭০ ফরজের সমান (হাদিস)

-তাহলেই কেবল রোযা তাকওয়া অর্জনে সহায়ক হবে।

-ইসলামের মৌলিক সকল ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন।  যেমনঃ সালাত (ও ইন্নাহু লা কাবিরাতুন ইল্লা আলাল খাশিয়িন), কুরবানী (ওলা কি ইয়ানালুত তাকওয়া মিনকুম)

-তাকওয়াবান লোকদের জন্য রয়েছে জান্নাত (উইদ্দাত লিল মুত্তাকুন, তিলকাল জান্নাতুল্লাতি নুরিসু মিন ইবাদিনা মান কানা তাকিয়া)

১৮৪নং আয়াতঃ

-এই আয়াতটি মূলত পূর্বের আয়াতের বিধানের বিস্তারিত ব্যাখ্যা।

-এখানে মূলত নির্ধারিত মাসে যারা রোযা রাখতে সক্ষম হবে না, তাদের করণীয় আলোচনা করা হয়েছে।

-দুই শ্রেণীর লোকদের রমযান মাসের রোযা থেকে সাময়িক রুকসদ দেয়া হয়েছে। এক শ্রেণী হচ্ছে অসুস্থ আর আরেক  শ্রেণী হলো মুসাফির। 

-অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তিরা পরবর্তীতে না রাখা রোযাগুলোর কাযা আদায় করবে।

-তবে যদি পরবর্তীতে রাখতেও অসমর্থ হয়, তবে তাকে ৬০ জন মিসকীনকে পেট ফুরে খাওয়ানোর বিধান বর্ণিত হয়েছে।

-তবে কেউ যাতে এটাতে অজুহাত হিসেবে নিয়ে রোযা রাখা থেকে নিবৃত্ত না থাকে তাই বলা হয়েছে রোযা রাখাটাই উত্তম।

১৮৫নং আয়াতঃ

"রমজান মাস, এই মাসেই করআন নাযিল হয়েছে"

-অর্থাৎ এটি হলো কিতাব নাযিলের মাস। শুধু কুরআন নয়, প্রায় সকল কিতাব এ মাসে নাযিল হয়েছে যেমনঃ

-১ম রমজানে ইব্রাহিমের ছহিফা নাযিল হয়, ৬ষ্ঠ রমজানে তাওরাত নাযিল হয়, ১৩ রমজানে ইঞ্জিল নাযিল হয় এবং ২৩ রমজান অর্থাৎ কদরের রাতে কুরআন নাযিল হয় (মুসনাদে আহমদ)
-শাহারু রমাদানাল্লাযি উনযিলা ফিহিল কুরআন (বাকারাঃ ১৮৫)
-ইন্না আনযালহু ফি লাইলাতিল কদর (কদরঃ ১)
-এ মাসের বুজুর্গি আল্লাহ কুরআন দিয়ে বর্ণনা করেছেন (এ যেনো কস্তুরি পাওয়া হরিণের মত)
-কুরআন বুঝে সে অনুসারে জীবন গঠন করা।

-তাই এ মাসে বেশি না ঘুমিয়ে সময়কে কাজে লাগানো দরকার (অর্থসহ তেলাওয়াত, তাফসীর, আয়াত-হাদীস ও সুরা মুখস্ত, সীরাত ও ফিকাহ অধ্যয়নের মাধামে)

কুরআনের মাহাত্ম্যঃ

-কুরআন বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ (হাজা বায়ানা লিন্নাস, তিবিয়ানা লি কুল্লি শাই)

-কুরআন একমাত্র টেক্সট বই (হাজা কিতাব মিসাদ্দিকাল লিসানান আরাবিয়া)

-কুরআন মানুষের জন্য জিকির (ইন্না নাজ্জালনা কুরআনা জিকরি, বাকিসব অন্য প্রাণীদের জিকির)

-কুরআন আমাদের কাছে আমানত (ইন্না আরাদনাল আমানাতা, লাও আনজালনা হাজাল কুরআনা)

-কুরআন সফলতার একমাত্র পথ (ওত্তাবায়ু নুর আল্লাজি উনজিলা মায়াহু)

-কুরআন এক সন্দেহাতীত কিতাব (লা রাইবা ফি, ও ইন কুনতুম ফি রাইবিম)

-কুরআনের মত কেউ বানাতে পারবে না (তৎকালীন ইমরুল কায়েসের যোগ্যতা, সুরা কাউসারের চ্যালেঞ্জ, কুল লা ইনিস তামাতু)

-কুরআন আজ বিশ্বের দার্শনিকদের কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার (All the letter of this, This holy book, একই জিহ্বা থেকে রাসুলের কুরআন ও হাদীস বের হয়েছে- বাহারে তলব)

-সকল কিতাবের সন্নিবেশ কুরআন (ও ইন্নাহু লাফি যবুরিল, এর অর্থ gather)

-কুরআনের সামনে কোন কিতাব চলবে না (হাযা নুসকাতিম মিন তাওরাত)

-কুরআন জাহেলি মানুষগুলোকে সোনার মানুষে পরিবর্তিত করেছে (উতার কার গারে হেরা সে)

-কুরআন আমাদের নেতৃত্বের আসন দিয়েছে (ইয়ে জমানে তো মুয়াজ্জাজ কা)

-কুরআন সহীহ তেলাওয়াত শিখা (নামাজ ভাঙকর কারন, হুব্বা কারিয়ুল কুরআন, পড়তে হবে ফজরে-ও কুরআনার ফজর ইন্না কুরানাল, ও ইযা তুলিয়াত আলাইহিম আয়াতুহু)

-কুরআন বুঝা ফরজ (আফালা ইয়া তাদাব্বারুল -মুহাম্মদ: ২৪, এটি ব্রাম্মনদের কোন কিতাব নয়, কাইফা ইজহাবু ইলম ইয়া রাসুলুল্লাহ)

-জীবনের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু বুঝতে হবে, গবেষক সবাই হবে না কিন্তু হতে হবে কিছু লোক (ফালাওলা নাফারা মিল কুল্লি ফিরকাতুম মিনহুম)

-কুরআনের আলোকে নিজেদের তৈরি (রিসুল ছিলেন জীবন্ত কুরআন)

-কুরআনের ব্যাপারে অবহেলা দুনিয়াও আখিরাতের শাস্তির কারন (ওমান আরাদা আন জিকরিহি, ওক্বলার রাসুলু)

-কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে তিনি হবেন বর্বর (If you teach your children, একজন ইহুদির বাচ্চা তারা প্রথম তাওরাত শিখায়)

-কুরআনের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা (আল কুরআনকে ভালোবেসে, এসো কুরআনের আলো মেখে, আল কুরআনের পথ এই পথই আসল পথ)


শিক্ষাঃ

-সকল কাজে আল্লাহর ভয় তৈরি হওয়া (লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন)

-সবই আল্লাহর সিদ্ধান্তে করতে হবে (হালাল জিনিস যেভাবে আল্লাহ দিনের বেলা গ্রহন করা হারাম করেছেন তার মানে এসবের মালিক আমরা নয়)

-ক্ষুধার্তদের কষ্ট বুঝতে পারা (কি যাতনা বিষে)

-বাকি ১১ মাস একই প্র্যাকটিস অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।

-এ মাসে নিজের নতুন করে গড়ে তোলা (রমজান স্রেফ রোযা সে নেহি, ইয়ে ছোট ছোট আচ্ছা সেভি বানায়ে জাতা)

-যাবতীয় খারাপ থেকে বাঁচা (মিথ্যা বলা চাড়লো না যে,  মৃত ভাইয়ের গোশত খেলো গীবত করে)

-কুরআনের আলোকে নিজেকে তৈরি করা।


সুরা মুমিনুন (১ম রুকু)

সফল মুমিনদের কতীপয় গুণাবলী

সরল অনুবাদঃ
১. নিশ্চিতভাবে মুমিনরা সফলকাম হয়েছে। 
২. যারা নিজেদের নামাজে বিনয় ও নম্র। 
৩. যারা বাজে বা বেহুদা কথা কাজ থেকে দুরে থাকে।
৪. যারা তাজকিয়া বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়।
৫. এবং যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।
৬. তবে তাদের স্ত্রীদের ও মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না।
৭. তবে যদি কেউ তাদের ছাড়া অন্য কাউকে (যৌন ক্ষুধা মেটাবার জন্য) কামনা করে তবে তারা হবে সীমালংঘনকারী।
এবং যারা তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদা চুক্তির (অঙ্গীকার) রক্ষনাবেক্ষন করে।
৯. এবং যারা তাদের নামাযসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষন করে।
১০. তারাই (এসব গুনের অধিকারী) উত্তরাধিকার লাভ করবে।
১১. তারা উত্তরাদিকার হিসাবে ফিরদাউস পাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে।


সুরা পরিচিতিঃ
সুরা নং- ২৩
মোট আয়াত- ১১৮
মোট রুকু- ৬
নাযিল- মক্কায়
পূর্ববর্তী সুরা- হাজ্জ্ব
পরবর্তী সুরা- নুর

নামকরনঃ
সুরার নামকরন দুই ভাবে হয়ে থাকে-
সুরার মধ্যে থাকা বহুল আলোচিত শব্দ (শব্দ ভিত্তিক)
যেমন- নাসফালাক
বিষয়ভিত্তিকঃ যেমন- ফাতেহাইখলাস
এ সুরাটি ১ম আয়াতের قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ  থেকে নামকরন করা হয়েছে ‘‘সুরা মুমিনুন’’। যার অর্থ মুমিনগণ, বিশ্বাসীগণ, ঈমান আনায়নকারীগণ, The Believers.
মুমিনুনের এক বচন মুমিন এই নামে কুরআনের ৪০ নং সুরা মুমিন অবতীর্ণ হয়েছে।
মুমিনুনের বিপরীথ শব্দ কাফিরূন এই নামে কুরআনের ১০৯ নং সুরা কাফিরূন অবতীর্ণ হয়েছে।

নাযিল হবার সময়কালঃ
সুরাটি মক্কীহিজরতের পূর্বে নাজিল হয়েছে। তবে ঠিক কোন সময়ে নাজিল হয়েছে তা সঠিক ভাবে বলা যায় না। বর্ণনাভঙ্গি ও বিষয়বস্তু হতে প্রতিয়মান হয় যেএ সুরা রাসুল করীম (সঃ) এর মক্কী জীবনের মাঝামাঝি সময়ে নাজিল হয়েছিল।
এই সুরা নাযিল হওয়ার আগেই হযরত ওমর রা: ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন এই সুরাটি তার সামনেই নাযিল হয়। অহি নাযিলের সময় রাসুলের অবস্থা কেমন হয় তা তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন (সুরা মুজ্জাম্মিলের ৫নং আয়াত)।

শানে নুযূল/পটভূমিঃ
অত্র সুরা বিশেষ করে তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো নাজিলের মক্কার কাফেররা যেমন ছিল ইসলামের চরম বিরোধী তেমনি পার্থিব উপকরণ সব ছিল তাদের হাতের মুঠোয় (বাণিজ্য)। অপরদিকে মুসলমানদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। (আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানগত)। এই অবস্থায় কাফেররা নিজেদের অধিক সফল এবং মুসলমানদের ব্যর্থ মনে করত। তখন মুমিনদের প্রকৃত সফলতার ঘোষণা দিয়ে এ আয়াতগুলি নাজিল করেন।
প্রকৃত সফলতার অর্থ তাফসীর কারকগণ ব্যাখ্যা করেছেন কোন একটি সুন্দর দালানে এক ব্যক্তি ৫ দিন থাকতে পারবে এবং যদি কুড়েঘরে থাকে তবে সারাজীবন থাকতে পারবে- এক্ষেত্রে একজন বুদ্ধিমান কোনটি বেছে নেবে।
অথচ আখেরাতে চিরজীবনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা আছে।

মূল বিষয়বস্তুঃ
এ সুরার মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে রাসুলের আনুগত্য করার আহ্বান। সুরার প্রথমে এ আলোচনা করা হয়েছে যেনবীর অনুসারী মুমিনদের কতিপয় গুনাবলী রয়েছেএই বিশেষ গুণাবলী অর্জনকারীরাই সফলকাম। ইহকালে ও পরকালে তারাই সাফল্য লাভকরবে। পরে এ সুরায় মানব সৃষ্টির বিভিন্ন স্তরের কথা আলোচনা করা হয়েছে এবং স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যেযিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম তিনি তোমাদেরকে পরকালে তার সামনে হাজির করতেও সক্ষম। তিনি তোমাদের হিসাব-কিতাব নিবেন। এ সুরায় আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তেমনিভাবে বিভিন্ন উম্মতের কথা উল্লেখ করে তাদের পরিনতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যেন দুনিয়াবাসী নবী করীম (সঃ) এর আনুগত্য করেআল্লার বিধানকে মেনে নেয়তারই ইবাদত করে। আল্লাহর ও তার রসুলের আনুগত্য না করলে কেউ মুক্তি পাবে না এসব বিষয়গুলিই এ সুরায় আলোচনা করা হয়েছে।


সুরা মুমিনুনের ফজিলতঃ
হযরত উমর (রাঃ) বলেন রসুল (সঃ) এর প্রতি যখন অহি নাজিল হত তখন মৌমাছির গুঞ্জনের ন্যায় আওয়াজ শুনা যেত। একদিন তাঁর কাছে এমনি আওয়াজ শুনে আমরা অহি শুনার জন্য থেমে গেলাম। অহির বিশেষ এ অবস্থার শেষ হলে নবী করীম (সঃ) কেবলামুখী হয়ে বসে পড়লেন এবং দোয়াকরতে লাগলেন,
اَللّهُمَّ زِدْنَا وَلَا تَنْقُصْنَا وَأَكْرِمْنَا وَلَا تُهِنَّا وَأَعْطِنَا وَلَا تَحْرِمْنَا وَآثِرْنَا وَلَا 
 تُؤْثِرْ عَلَيْنَا وَاَرْضِنَا وَارْضَ عَنَّا
হে আল্লাহ! আমাদেরকে বেশী দাও কম দিওনা। আমাদের সম্মান বৃদ্ধি কর- লাঞ্ছিত করো না। আমাদেরকে দান কর-বঞ্চিত করো না। আমাদেরকে অন্যের উপর অধিকার দাও অন্যদেরকে আমাদের উপর অগ্রাধিকার দিয়ো নাআমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাক এবং আমাদেরকে তোমার  সন্তুষ্ট কর।”(তিরমিজি) 
এরপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেনঃ এক্ষণে দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে। কেউ যদি এ আয়াতগুলো পুরোপুরি পালন করেতবে সে সোজা জান্নাতে যাবে। এরপর তিনি সুরা মুমিনুনের প্রথম দশটি আয়াত পাঠ করে শোনালেন। (আহমাদ)
ইমাাম নাসায়ী তফসীর অধ্যায়ে ইয়াযিদ ইবনে কাবনুস বর্ণনা করেছেন যেহযরত আয়েশা (রাঃ) কে প্রশ্ন করা হয় যেরাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর চরিত্র কিরূপ ছিলতিনি বললেন তার চরিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে অতঃপর তিনি এই দশটি আয়াত তেলাওয়াত করে বললেনঃ এগুলোই ছিল রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর চরিত্র ও অভ্যাস। (ইবনে কাসীর)

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাঃ
এখানে قد افلح মানে সফলকাম হয়ে গেছে।
ইংরেজি করলে করলে যার অর্থ হবে He had been Succeed.
-ভবিষ্যতের সফলতার নিশ্চয়তা বুঝাতে Past Perfect  Continuous tense ব্যবহার করা হয়েছে।

যেহেতু সফলতার ঘোষনা মুমিনদের জন্য, তাই আমাদের জানতে হবে ঈমান কি?
-ঈমান মানে বিশ্বাস, যার কেন্দ্রবিন্দু হলো আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা।
-ঈমানে ১ম সাক্ষ্য হলো কালেমার ঘোষনা দেয়া (কালেমায়ে তাইয়্যেবা ও কালেমায়ে শাহাদাত যার বিষয়বস্তু)
-এছাড়া ঈমানে মুফাসসালের ৭টি বিষয় হলো ঈমানে পূর্নাঙ্গ ও বিস্তারিত বিষয় (কুরআনে রয়েছে ৬টি পর্যায়ের কথা)
-এই ৭টি পর্যায় আবার ৩টি দিকের সাথে সম্পর্কিত (তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত) [মজবুত ঈমান বই]
-ঈমানের শর্তই হলো গায়েবের প্রতি বিশ্বাস (ইয়ুমিনুনা বিল গাইবি...বাকারা)
-অথচ নাস্তিকরা বলে যা দেখি না তা বিশ্বাস করে (মজবুত ঈমান বই)
-ঈমানের পর্যায় তিনটি- ইকরার বিল লিসান, তাশদীদ ফিল জিনান, আমল বিল আরকান (ওমিনান নাসি মাইয়া কুলু.....খেরাদনে কার কেহবি দিয়া.....আবু তালেবের মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্তের ঘটনা)
-ঈমান মোট শাখা ৬০-৭০টির বেশি (আল ঈমানু বিদয়ু ও সাবয়ুনা আও বিদয়ু ও সিত্তুনা শুবা.....ও আদনাহা ইমাতাত আল আদয়া আনিন তারিখ....) [আবু হুরাইয়া: মুত্তাফাকুন আলাইহি]
অর্থাৎ সবচেয়ে বড় শাখা কালেমার ঘোষনা, সবচেয়ে ছোট শাখা পথ থেকে কাঁটা সরানো
-প্রকৃত ঈমান প্রমান হয় পরিক্ষা আসলে,
"কার কতটা ঈমান আছে সময় হলো পরিক্ষার....(মল্লিক)
-আহাসিবান্নাসু আইয়ুত রাকু আইয়া কুলু আমান্না....(আনকাবুত-২)
-ঈমানে দাবি সেতো বসে থাকা নয়, ঈমান দাবি হলো কিছু বিনিময়....(মল্লিক)
-যে ঈমান প্রয়োজনে জ্বলে ওঠে না....
-তাই আমাদের ঈমান এক্বীন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে...(ইলমাল ইয়াক্বীন ও আইনাল ইয়াক্বীন)
-হযরত ওমর রা. বলেন, আল্লাহর জান্নাত দেখলে আমি অবাক হবো না.... (অথচ হাদিসে আছে- মা লা আইয়ুন রাদ)


আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তায়লা সেসব মুমিনকে সাফল্য দান করার ওয়াদা করেছেন। যারা আয়াতে উল্লিখিত ৭ টি গুনে গুনান্বিত। পরকালের পূর্ণাঙ্গ সাফল্য এবং দুনিয়ার সম্ভাব্য সাফল্য সবই এই ওয়াদার অন্তর্ভুক্ত।
এই আয়াতসমূহ ছাড়াও কুরআনে সফল মুমিনদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন:
 
সুরা আনফলের ২-৩ আয়াতে বলা হয়েছে ৫ টি গুণের কথা:
১. আল্লাহর স্মরণে অন্তর কেঁপে উঠে।
২. আল্লাহর আয়াত শুনলে ঈমান বাড়তে থাকে।
৩. আল্লাহর প্রতি একমাত্র ভরসা করে। 
৪. সালাত কায়েম করে।
৫. রিযিক থেকে দান করে।
 
সুরা তাওবার ৭১ নং আয়াতে বলা হয়েছে ৪ টি গুণের কথা:
১. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা।
২. সালাত কায়েম করা।
৩. যাকাত আদায় করা।
৪. আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করা।
 
সুরা আহযাবের ৩৫ নং আয়াতে ১০ টি গুণের কথা বলা হয়েছে:
১. আত্মসমর্পনকারী
২. বিশ্বাসী
৩. অনুগত 
৪. সত্যবাদী
৫. ধৈর্য্যশীল
৬. বিনয়ী
৭. দানশীল
৮. রোজাদার
৯. লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী
১০. আল্লাহর জিকিরকারী।

উল্লেখিত আয়াতগুলোতে মুমিনদের সাতটি গুণ:
সর্বপ্রথম গুন হলো ঈমানদার হওয়া। কিন্তু এটা একটা বুনিয়াদী ও মৌলিক বিষয় বিধায় এটাকে এই সাতটি গুনের মধ্যে শামিল না করে পর পর সাতটি গুন বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রথম গুনঃ
 ‘‘যারা তাদের নামাযে বিনয়ী ও নম্র’’
নামাযে খুশু বলতে বিনয় ও নম্র হওয়া বুঝায়। খশুর আভিধানিক অর্থ স্থিরতা। শরীয়তের পরিভাষায় এর মানে অন্তরে স্থিরতা থাকা। অর্থ্যাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর কল্পনা অন্তরে ইচ্ছাকৃত ভাবে না করা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থির রাখা।
দিলের খুশু হয় তখন যখন কারো ভয়ে বা দাপটে দিল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আর দেহের খুশু এভাবে প্রকাশ পায় যেকারো সামনে গেলে তার মাথা নিচু হয়ে যায়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হয়ে পড়ে চোখের দৃষ্টি নত হয়ে আসেগলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়।
হাদীসে হযরত আবু যার (রা:) থেকে বর্ণিত আছেরাসূল (সা:) বলেন- নামাযের সময় আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি সর্বক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন যতক্ষণ না নামাযী অন্যদিকে ভ্রুক্ষেপ করে। যখন সে অন্যকোন দিকে ভ্রুক্ষেপ করে তখন আল্লাহ তায়ালা তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। (নাসায়ী) (আবু দাউদ)

যেসব কাজ নামাযে খুশু সৃষ্টিতে বাধা দেয়ঃ
১. নামাযের মধ্যে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলা করা বা নাড়াচাড়া করা।
হাদীস- একবার নবী (সা:) এক ব্যক্তিকে নামাযের মধ্যে মুখের দাড়ী নিয়ে খেলা করতে দেখে বললেন-
لَوْ خَشَعَ قَلْبُ هذَا خَشَعَتْ جَوَارِحُه
যদি এ লোকটির দিলে খুশু থাকত তাহলে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপরও খুশু থাকত। (বায়হাকী)
২.  নামাযে এদিক ওদিক তাকালে নামাযে একগ্রতা বা খুশু নষ্ট হয়ে যায়। এ সম্পর্কে নবী (সা:) বলেন- এটা নামাযীর (মনোযোগের) উপর শয়তানের থাবা।
৩. নামাযে ছাদ বা আকাশের দিকে তাকালে নামাযের খুশু নষ্ট হয়ে যায়। নবী করিম (সা:) বলেন 
লোকেরা যেন নামাযে তাদের চোখকে আকাশমুখী না করে। (কেননা তাদের চোখ) তাদের দিকে ফিরে নাও আসতে পারে।’(বুখারী)
৪. নামাযে হেলা-ফেলা করা ও নানাদিকে ঝুকে পড়া।
৫.  সিজদায় যাবার সময় বসার জায়গা বা সিজদার জায়গা বার বার পরিস্কার করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। (তবে ক্ষতিকারক হলে একবার সরানো যাবে)
মহানবী (সা:) বলেন-
إِذَا قَامَ أَحَدُكُمْ إِلَى الصَّلاَةِ فَإِنَّ الرَّحْمَةَ تُوَاجِهُهُ فَلاَ يَمْسَحِ الْحَصَى
কোন ব্যক্তি যেন নামাযের অবস্থায় (সিজদার জায়গা হতে) কংকর না সরায়। কেননা আল্লাহর রহমত নামাযী ব্যক্তির উপর প্রসারিত হয়।’ (আহমেদনাসায়ীতিরমিযীআবু দাউদইবনে মাযাহ)
৬.    একটানা গর্দান খাড়া করে দাড়ানো এবং খুব কর্কশ স্বরে কোরআন পড়া কিংবা গীতের স্বরে কুরআন পাঠ।
৭. জোরে জোরে হাই এবং ঢেকুর তোলা। ইচ্ছা করে গলা খেকরা বা কাশি দিলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়।
রাসূল (সা:) বলেন- নামাযে হাই ওঠে শয়তানের প্রভাব থেকে যদি কারো হাই ওঠে তার উচিত সে যেন সাধ্যমতো হাই প্রতিরোধ করে। (মুসলিমতিরমিযী)
৮. তাড়াহুড়ো করে নামায আদায় করা। নামাযে রুকু সিজদা কিয়াম সঠিক ভাবে আদায় না করা।
নবী (সা:) বলেন,
মদখোরব্যভিচারী ও চুরি করা কবীরা গুনাহ এবং তার সাজাও খুব তবে সবচেয়ে জঘন্য চুরি হলো সেই যে ব্যক্তি নামাযে চুরি করে। সাহাবীরা বললেন নামাযে কিভাবে চুরি হয়। রাসূল (সা:) বললেন নামাযে রুকু ও সিজদা ঠিকমতো না করা।’ (মালেকআহমেদদারেমী)
৯. নামাযীর সামনে পর্দায় কোন ছবি থাকলে নামাযে খুশু বা একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়।

নামাযে খুশু সৃষ্টির জন্য যা করতে হবেঃ
১.  আল্লাহ তায়ালাকে সবসময় হাজির নাজির জানা।
হাদীসে জীবরীলে ইহসান সম্পর্কে মহানবী (সা:) কে রাসূল (সা:) প্রশ্ন করলে তার প্রতিউত্তরে তিনি বলেন,
أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ ، فَإِنَّهُ يَرَاكَ
তুমি এভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে (নামাযে) যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তোমার পক্ষে এটা সম্ভব না হয়। তবে তুমি অবশ্যই মনে করে নেবে যে আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।”
২.  নামাযে পঠিত দোয়াকালাম অন্তর থেকে পড়া। (তাকবীরে তাহরীমা থেকে শুরু করে সালাম ফিরানো পর্যন্ত রাসুলের শিখানো দোয়াসমূহ পাঠ করা) 
৩.  নামাযে খুশু সৃষ্টি করার জন্য নামাযীর দৃষ্টি সিজদার দিকে থাকবে। 
৪.  নামাযে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য নামাযে যা পড়া হয় তার অর্থ জানা। 
৫. সালাত কায়েমের সঠিক তৎপর্য জানা। (সালাতের একটি তাৎপর্য হলো সমতা বিধান)
আল্লামা ইকবাল বলেন, ‘‘একি সামনে খাড়ে হো গে মাহমুদ ও আয়াজ, নাকো বান্দা নাহা নাকো বান্দা নায়াজ’’
আর এভাবে সালাত আদায় করতে পারলে  েই সালাত হবে, ‘‘ইন্না সালাতি ও নুসুকি ওমা হিয়ায়া ও মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’’ (নামাজ পারে রুখতে সকল অন্যায় অশ্লীল....)

দ্বিতীয় গুনঃ 
যারা বেহুদা কাজ ও কথা থেকে দুরে থাকে।’
অর্থাৎ এমন প্রতিটি কাজ এবং কথাকে যা অপ্রয়োজনীয়অর্থহীন ও নিস্ফল। যেসব কথা এবং কাজের কোনই ফল নেই।
اللَّغْوُ “এর অর্থ উচ্চস্তরের গুনাহ যাতে ধর্মীয় উপকার তো নেই বরং ক্ষতি বিদ্যমান।
রাসূল (সা:) বলেন-
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُه مَالَا يَعْنِيْهِ
মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে তখন ইসলাম সৌন্দর্যমন্ডিত হয়।(তিরমিজি)।” 
আল্লাহ বলেন-
وَإِذَا مَرُّوا بِاللَّغْوِ مَرُّوا كِرَامًا
অর্থ্যাৎ- “যখন এমন কোন জায়গা দিয়ে তারা চলে যেখানে বাজে কথা হতে থাকে অথবা বাজে কাজের মহড়া চলে তখন তারা ভদ্রভাবে সে জায়গা অতিক্রম করে চলে যায়।” ( ফুরকান-৭২)
-জান্নাতি বৈশিষ্ট্য এমন হবে। জান্নাতে কোন বেহুদা কথা বা কাজ হবে না (লা ইয়াসমায়ুনা ফি লাগওয়াও ওলা কিজ্জাবা)
-আল্লাহর প্রিয় বান্দারা অনর্থক বিতর্ক থেকে বেঁচে থাকে (ও ইয়া খাতাবুহুম জাহিলুনা ক্বলু সালাম)
-আমাদের উচিত চুপ থাকার অভ্যাস (ওমান সমাতা নাজাহ....ফাল ইয়াকুল খাইর আওলি আসমত...সময় হলো ধারালো চুরির মত)
-মুমিনের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত গনিমত মনে করা উচিৎ (জিন্দেগী ইনসানু কি এক দমকে সাওয়া কুচ বি নেহি....Out out brief canddle....)
-অযত্নে সময় কাটানো আমাদের উপমহাদেশের মানুষদের মধ্যে বেশি (জন দশেকে জটলা করি তক্তপোষে বসে....জীবনের স্রোত আকাশে ঢালি, হৃদয় তলে বহ্নি জ্বালি চলিছে নিশীদিন)

তৃতীয় গুনঃ
যারা যাকাত বা পরিশুদ্ধির ব্যাপারে কর্মতৎপর হয়"
যাকাত দেয়া বা যাকাতের পথে কর্মতৎপর সক্রিয় হওয়ার মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে বিকট পার্থক্য বিদ্যমান।
মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে কুরআনের
বিশেষ ধরনের অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এটা বলার পেছনে তাৎপর্য আরবী ভাষায় যাকাত শব্দের দুটি অর্থ বিদ্যমান
১। বিত্রতাপরিশুদ্ধতাপরিশুদ্ধি।
২।  বিকাশ সাধন কোন জিনিসের সাধনে যেসব জিনিস প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায় সেসব দুর করা এবং তার মৌলবস্তুকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করা।
এই দুটি ধারনা মিলিয়ে যাকাতের পরিপূর্ণ ধারনা সৃষ্টি হয়। তারপর এই শব্দটিইসলামী পরিভাষায় ব্যবহৃত হলে এর দু’টি অর্থ প্রকাশ পায়-
১)    এমন সম্পদ যা পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বের করা হয়।
২)    পরিশুদ্ধ করার মূল কাজটি-
 যদি বলা হয় তবে এর অর্থ হবে তারা সম্পদ পরিশুদ্ধির উদ্দেশ্যে সম্পদের একটি অংশ নেয়।
 কিন্তু যদি বলা হয় তবে তার অর্থ হবে তারা পবিত্রতাপরিশুদ্ধতা তাযকিয়ার কাজ করছে। এ অবস্থায় ব্যাপারটি শুধুমাত্র আর্থিক যাকাত আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং এর অর্থ ব্যাপক হবে। যেমনঃ
Ø  আত্মার পরিশুদ্ধি
Ø  চরিত্রের পরিশুদ্ধি
Ø  জীবনের পরিশুদ্ধি
Ø  তার পারিবারিক পরিশুদ্ধি
Ø  নিজেরসমাজ এবং রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি।
Ø  অর্থের পরিশুদ্ধি।

উপরোক্ত প্রত্যেকটি দিকের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত এর ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়বে। এছাড়া এর অর্থ কেবল নিজেরই জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। না বরং নিজের চারপাশের জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়বে।
কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى (১৪) وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى (১৫)
অর্থ্যাৎ “কল্যাণ ও সফলতা লাভ করল সেযে পবিত্রতার কাজ করলো এবং নিজের রবের  নাম স্মরণ করে নামায পড়লো।” (সুরা আ’লা:১৪,১৫)
আল্লাহ বলেন-
  قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا (৯) وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا (১০)
সফলকাম হলো সেযে নিজের নফসকে পবিত্র বা তাযকিয়া করলো। আর ব্যর্থ হলো সে যে নিজেকে কলুষিত করল।” (সুরা আশ শামস:৯,১০)
এ আয়াতে গোটা সমাজ জীবনের কথা বলা হয়েছে।

চতুর্থ গুণঃ
‘'যারা লজ্জাস্থানের হেফাজত করেন। তবে তাদের স্ত্রীদের এবং মালিকানাভুক্ত দাসীদের ক্ষেত্রে সংযত না করলে তারা তিরস্কৃত হবে না। তবে কেউ যদি এদের ছাড়া অন্য কাউকে কামনা তবে এক্ষেত্রে তারা হবে সীমালংঘনকারী।"
লজ্জাস্থান হেফাজত করার দুটি অর্থ হতে পারে।
১) নিজের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখা।
২) যৌন শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাগামহীন হয় না।
এটি প্রাসঙ্গিক বাক্য। “লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।” বাক্য থেকে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করার জন্য।
লজ্জাস্থানের সাধারণ হুকুম থেকে দু’ধরনের লোককে বাদ দেয়া হয়েছে।
১. স্ত্রী অর্থাৎ যেসব নারীকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছে।
২. দাসী অথাৎ এমন বাদী যার উপর মানুষের মালিকানা অধিকার আছে। সুতরাং মালিকানাধীন দাসীদের যৌনসম্পর্ক বৈধ এবং বৈধতার ভিত্তি বিয়ে নয়। কারণ এখানে স্ত্রী ও দাসী আলাদা ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এ বাক্যটি উপরোক্ত দুটি পন্থা ছাড়া কামনা চরিতার্থ করার যাবতীয় পথ অবৈধ করেছে। হারাম উপায়গুলি-
২. যিনা যেমন হারাম তেমনি হারাম নারীকে বিয়ে করাও যিনার মধ্যে গণ্য।
২. স্ত্রী অথবা দাসীর সাথে হায়েজ-নেফাস অবস্থায় কিংবা অস্বাভাবিক পন্থায় সহবাস হারাম।
৩.পুরুষবালক বা জীবজন্তুর সাথে কামনা চরিতার্থ করা হারাম।
৪. অধিকাংশ তাফসীরবিদগণের মতে হস্তমৈথুন এর অন্তর্ভুক্ত।
৫. এছাড়া যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোন অশ্লীল-বই পড়াছবি দেখা।

উপরোক্ত সবকিছুই সীমালংঘনের মধ্যে গণ্য হবে।

৫ম ও ৬ষ্ঠ গুনঃ
তাদের আমানতসমূহ এবং ওয়াদা বা প্রতিশ্রতি রক্ষা করে।

আমানত প্রত্যাপর্ন করাঃ 
আমানত শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। আভিধানিক অর্থে এমন একটি বিষয় শামিল যার দায়িত্ব কোন ব্যক্তি বহন করে এবং সে বিষয়ে কোন ব্যক্তির উপর আস্থা রাখা যায় ও ভরসা করা যায়। বিধায় আমানত শব্দটি বহুবচন অর্থে ব্যবহৃত।
দু’ধরনের আমানত সংক্রান্ত কথা-
১. হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক।
২. হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক।

১)  হক্কুল্লাহঃ
 -শরীয়ত আরোপিত সকল ফরজ ও ওয়াজিব পালন করা এবং যাবতীয় হারাম ও মাকরুহ বিষয় থেকে দুরে থাকা।
 -মানুষ আল্লাহর খলিফা। খিলাফতের দায়িত্ব পালনের আমানত রক্ষা করা।


২)  হক্কুল ইবাদঃ
-কোন ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক আরোপিত ধনসম্পদের আমানত।
-গোপন কথার আমানত।
-মজুরশ্রমিক ও চাকরীজীবীদের জন্য যে কার্য সময় নির্ধারন করে দেয়া হয় তা পালন।
-দায় দায়িত্বের আমানত। সংগঠনব্যক্তিরাষ্ট্রপরিবার পরিচালক হিসেবে।
-গণতান্ত্রিক দেশে ভোটারদের ভোট আমানত।

আল্লাহ তায়ালা বলেন:
إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا
আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদরে হাতে ফরেত দবোর নর্দিশে দচ্ছিনে৷ (সূরা নিসা:৫৮)
রাসুল (সা:) বলেন:
إِيْمَانَ لِمَنْ لَا أَمَانَةَ لَه لَا
তার ঈমান নেই যার আমানতদারী নেই।” (আহমাদ)
তাছাড়া মোনাফেকের যে চারটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ১) ‘কোন আমানত তার কাছে সোপর্দ করা হলে সে তার খেয়ানত করে।’ (বুখারী)
وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ.

অঙ্গীকার পূর্ণ করাঃ 
অঙ্গীকার বলতে প্রথমতদ্বিপাক্ষিক চুক্তি বুঝায় যা কোন ব্যাপারে উভয়পক্ষ অপরিহার্য করে নেয়। এরুপ চুক্তি পূর্ণ করা ফরজ।
দ্বিতীয় প্রকার অঙ্গীকারকে ওয়াদা বলা হয় অর্থ্যাৎ এক তরফাভাবে একজন অন্যজনকে কিছু দেয়ার বা কোন কাজ করে দেয়ার অঙ্গীকার করা।
হাদীসে আছে, “ওয়াদাও এক প্রকার কসম”

সপ্তম গুনঃ 
যারা তাদের নামায সমূহকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে।
এখানে পাঁচওয়াক্ত নামায মুস্তাহাব বা আউয়াল ওয়াক্তে যথাযথভাবে পাবন্দী সহকারে আদায় করা বুঝায়।
এখানে নামায সমূহের সংরক্ষণ বলতে নামাযের বাইরের এবং ভেতরের যাবতীয় নিয়মনীতি যথাযথভাবে পালন করা। অর্থ্যাৎ আরকান-আহকাম পালন।
১।  শরীরপোশাকপরিচ্ছদ পাক পবিত্র।
২।  সময়মত নামায।
৩।  অযু ঠিকভাবে করে নামায আদায়।
৪।  জামায়াতের সাথে নামায।
৫।  শুদ্ধধীরস্থিরভাবে দোয়া কালাম পাঠ করা।
৬।  নামায প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নামাযের হেফাজত করা।
৭।  এহসানের সাথে নামায আদায়।

১১নং আয়াতঃ
‘‘তারা (এসবগুনের অধিকারীগণই) উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা উত্তরাধিকার হিসেবে ফেরদাউস পাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে"
এখানে উত্তরাধিকারী বলা হয়েছে এজন্য যে মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ যেমন উত্তরাধিকারদের নিশ্চিত প্রাপ্য। এবং গুণের অধিকারীদেরও জান্নাতে প্রবেশ সুনিশ্চিত।
সফলকাম ব্যক্তিদের গুনাবলী পুরোপুরি উল্লেখ করার পর এই বাক্যে আরও ইঙ্গিত আছে যে পূর্ণাঙ্গ সফল জান্নাতী ব্যক্তি।’’
الْفِرْدَوْس শব্দটি এমন একটি বাগানের জন্য বলা হয়ে থাকে যার চারিদিকে পাচিল দেয়া থাকে। বাগানটি বিস্তৃত হয়। মানুষের আবাস গৃহের সাথে সংযুক্ত হয় এবং সব ধরনের ফল বিশেষ করে আঙ্গুর পাওয়া যায়। কোন কোন ভাষায় এর অর্থের মধ্যে এ কথাও বোঝায় যে এখানে বাছাই করা গৃহপালিত পশু পাখি পাওয়া যায়।
কুরআনে বিভিন্ন সমষ্টিকে ফিরদাউস বলা হয়েছে।
তাদের আপ্যায়নের জন্য ফিরদৌসের বাগানগুলি আছে।”
এ থেকে মনের মধ্যে এ ধারনা জন্মে যে ফিরদৌস একটা বড় জায়গাযেখানে অসংখ্য বাগ বাগিচা উদ্যান রয়েছে।

শিক্ষাঃ
১।  সফলতা নিছক ঈমানের ঘোষনা দেয়ার নাম নয় বরং 'ঈমানান কামেলা'র নাম।
২।  পার্থিব ও বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সম্পদশালীতা সফলতা নয়। আখেরাতের স্থায়ী সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য। (অল আখিরাতি খাইরু ও আবকা)
৩।  খুশু খুযুর সাথে নামায আদায় করতে হবে।
৪।  বাজে কথাও কাজে সময় নষ্ট না করা।
৫।  সর্ববস্থায় নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে সচেষ্ট হওয়া।
৬।  অবৈধ পন্থায় কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার চিন্তাও না করা। (ওলা তাকরুবুজ জিনা)
৭।  আমানতের হেফাজত করা এবং অঙ্গীকার বা ওয়াদা যথাযথভাবে পালন করা।
৮।  প্রত্যেক নামায মোস্তাহাব ওয়াক্তে আদায় করা।

সর্বশেষ পোস্ট

যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস

ভূমিকা: ইসলামী আন্দোলন শুধু যুগ যুগ ধরে নয়। এ আন্দোলন শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে। এ আন্দোলন হাজার বছরের আন্দোলন। ঈসা আঃ এর আগমনের প্রায় ৬০০ বছ...

জনপ্রিয় পোস্ট