Showing posts with label দারসুল হাদিস. Show all posts
Showing posts with label দারসুল হাদিস. Show all posts

খাব্বাব ইবনে আরাত রা. বর্ণিত ত্যাগ-কুরবানি সংক্রান্ত হাদিস

 حَدَّثَنِي مُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى

[মুহাম্মদ ইবনে মুসান্না বলেছেন]

حَدَّثَنَا يَحْيَى

[ইয়াহইয়া বলেছেন)

عَنْ إِسْمَاعِيلَ

[ইসমাঈল হকে বর্ণনা করেন]

 حَدَّثَنَا قَيْس

[কায়েস বলেছেন]

عَنْ خَبَّابِ بْنِ الأَرَتّ 

[খাব্বাব ইবনে আরাত রা. হতে বর্ণিত]

 قَالَ شَكَوْنَا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم

[তিনি রাসুল সা. এর খেদমতে (কাফিরদের পক্ষ থেকে যে সব নির্যাতন ভোগ করছিলাম এসবের) অভিযোগ করলেন]

 وَهْوَ مُتَوَسِّدٌ بُرْدَةً لَهُ فِي ظِلِّ الْكَعْبَةِ

[তখন তিনি নিজের চাঁদরকে বালিশ বানিয়ে কা’বা শরীফের ছায়ায় বিশ্রাম করছিলেন]

 قُلْنَا لَهُ أَلاَ تَسْتَنْصِرُ لَنَا أَلاَ تَدْعُو اللَّهَ لَنَا 

[বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য (আল্লাহর নিকট) সাহায্য প্রার্থনা করবেন না? আপনি কি আমাদের (দুঃখ দুর্দশা লাঘবের) জন্য আল্লাহর নিকট দু’আ করবেন না?]

قَالَ "‏ كَانَ الرَّجُلُ فِيمَنْ قَبْلَكُمْ

[তিনি বললেন, তুমি কি জানো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর কি হয়েছে?]

 يُحْفَرُ لَهُ فِي الأَرْضِ فَيُجْعَلُ فِيهِ

[তাদের জন্য মাটিতে গর্ত খনন করা হত এবং ঐ গর্তে তাকে পুঁতে রাখা হতো]

 فَيُجَاءُ بِالْمِنْشَارِ، فَيُوضَعُ عَلَى رَأْسِهِ فَيُشَقُّ بِاثْنَتَيْنِ

[অত:পর একটি করাত* এনে মাথা দ্বিখন্ডিত* করা হতো]

 وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ

[এ (অমানুষিক নির্যাতনেও) তাদেরকে দ্বীন থেকে বিচ্যুত করতে পারত না]

 وَيُمْشَطُ بِأَمْشَاطِ الْحَدِيدِ

[লোহার চিরুনী দিয়ে শরীর আঁচড়ানো হতো]

مَا دُونَ لَحْمِهِ مِنْ عَظْمٍ أَوْ عَصَبٍ

[হাঁড় পর্যন্ত মাংস ও শিরা উপশিরা সব কিছু ছিন্নভিন্ন করে দিত]

وَمَا يَصُدُّهُ ذَلِكَ عَنْ دِينِهِ

[এ (লোমহর্ষক নির্যাতন) তাদেরকে দ্বীন থেকে বিমুখ করতে পারেনি]

وَاللَّهِ لَيُتِمَّنَّ هَذَا الأَمْرَ حَتَّى يَسِيرَ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلَى حَضْرَمَوْتَ

[আল্লাহর কসম! আল্লাহ এ দ্বীনকে অবশ্যই পূর্ণতা দান করবেন (এবং সর্বত্র নিরাপদ ও শান্তিময় অবস্থা বিরাজ করবে।) তখনকার দিনের একজন উষ্ট্রারোহী সান’আ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে]

لاَ يَخَافُ إِلاَّ اللَّهَ أَوِ الذِّئْبَ عَلَى غَنَمِهِ، وَلَكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُونَ ‏

[আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকেও অথবা মেষপালের জন্য নেকড়ে বাঘ ব্যতীত অন্য কিছুর ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা (ঐ সময়ের অপেক্ষা না করে) তাড়াহুড়া করছো]


রেফারেন্সঃ [সহীহ আল বুখারী]

ইসলামিক ফাউন্ডেশন নাম্বারঃ ৩৩৫৪

আন্তর্জাতিক নাম্বারঃ ৩৬১২


রাবী পরিচিতিঃ [খাব্বাব ইবনে আরাত রা:]

-মূল নাম ‘খাব্বাব’, কুনিয়াত আবু আবদিল্লাহ, তাঁর পিতার নাম হলো ‘আরাত’।

-জন্ম : তিনি বর্তমান সৌদি আরবের ‘নজদ’ এলাকার বনু তামিম গোত্রে হিজরতের ৩৩ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন।

-বাল্যকাল : বনু তামিম গোত্রে অন্য গোত্র আক্রমণ চালিয়ে সব পুরুষ হত্যা করে নারী আর শিশুদের বাজারে বিক্রি করে দেয়। 

-বনু খুজায়া গোত্রের ‘উম্মু আনমার’ নামে এক মহিলা বালক খাব্বাবকে খরিদ করে নিয়ে যায়। আর এভাবেই তার ওখানে বাল্যকাল শুরু হয়।

-পেশা/যোগ্যতা : তিনি কিশোর বয়সেই কয়লার আগুনে লোহা গরম করে গলিয়ে তরবারি/বর্ষা ইত্যাদি তৈরি করে এর ব্যবসা করতেন।

-ইসলাম গ্রহণ : বড় হওয়ার একপর্যায়ে তিনি শুনতে পেলেন মক্কায় মুহাম্মদ সা: নামক এক ব্যক্তি নতুন দ্বীন/ধর্ম প্রচার করছেন। তিনি রাসূল সা:-এর কাছে এসে তাঁর মুখে কুরআনুল কারিম শুনে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।

-তিনি ছিলেন ষষ্ঠ ইসলাম কবুল করা সাহাবি। ফলে তাকে সাদেসুল ইসলামও বলা হতো।

-শারীরিক নির্যাতন : তাঁর ইসলাম গ্রহণ প্রকাশিত হলে মালিক উম্মে আনমার ও তার ভাই শিবা ইবনু আবদুুল ওজ্জাসহ কয়েকজন মিলে খাব্বাবকে বলল, শুনলাম, তুমি না কি ধর্মত্যাগী হয়ে বনু হাশেম গোত্রের এক যুবকের অনুসারী হয়েছ? 

তখন তিনি খুবই স্পষ্টভাবে বললেন, আমি ধর্মত্যাগী হইনি বরং মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে, এক আল্লাহর ওপর ঈমান এনে মুহাম্মদ সা:-কে তাঁর বান্দাহ ও রাসূল হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছি। এ কথা বলার সাথে সাথে তার ওপর অতর্কিত বর্বর সন্ত্রাসী হামলা শুরু হওয়ায় তিনি রক্তাক্ত হয়ে পড়লেন মুহূর্তের মধ্যে। একপর্যায়ে তাকে লোহার পোশাক পরিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পিপাসায় বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলেও দ্বীন ছেড়ে দেননি তিনি।

-তিনি বলতেন, ইসলাম কবুল করার কারণে কাফেররা কতগুলো পাথরের টুকরা প্রচণ্ড গরম করে এর ওপর আমাকে শুইয়ে দিয়ে একজন শক্তিশালী মানুষ তার পা আমার বুকের ওপর রেখে দাঁড়িয়ে থাকত, যেন আমি নড়াচড়া না করতে পারি। কখনো কখনো জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর চিৎ করে শুইয়ে দেয়া হতো। ফলে, আমার চামড়া, চর্বি, রক্ত ও মাংস গলে গলে আগুন নিভেছে।

-দাওয়াতি কাজ : ইসলাম গ্রহণের পরপরই তিনি মক্কায় দাওয়াতে তাবলিগের কাজ শুরু করে দেন। ওমর রা:-এর বোন ফাতিমা রা: এবং তার স্বামী সাঈদ রা:-কে কুরআনুল কারিম শিক্ষা দিতেন।

-হিজরত : অসংখ্যবার নির্যাতন ভোগের পর তিনি প্রথম দিকেই মদিনাতুল মুনাওয়ারায় হিজরত করেন।

-যুদ্ধে অংশগ্রহণ : তিনি বদর, উহুদসহ প্রায় সব ক’টি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।

-হাদিস বর্ণনা : তিনি রাসূল সা:-এর কাছ থেকে ৩৩টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে বুখারি-মুসলিমে তিনটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এককভাবে বুখারিতে দু’টি আর মুসলিমে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

-ইন্তেকাল : তিনি ৩৭ হিজরিতে কুফায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে চিকিৎসা করানোর পরও ভালোর চেয়ে খারাপ হতে হতে ৩৯ হিজরিতে, ৭২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হজরত আলী রা: জানাজার নামাজে ইমামতি করেন। এরপর তার শেষ অসিয়ত অনুযায়ী কুফার বাইরে এক জায়গায় তাকে কবরস্থ করা হয়।


গ্রন্থ পরিচিতিঃ [সহীহ আল বুখারী]

-আল কুরআনের পর বুখারীর স্থান।

-এটি সিহাহ সিত্তাহ'র বিখ্যাত গ্রন্থের অন্যতম।

-একে কুতুব আল সিত্তাহ বলা হয়।

-এর রচয়িতা ঈমার বুখরী র.

-বুখারী শরীফের পুরো নাম- আল জামী আস সহীহ আল মুসনাদ মিন উমুরি রাসুলুল্লাহি সা. ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়ামিহি।

-অনুপ্রেরণাঃ ঈমাম বুখারীর উস্তাদ ইসহাক ইবনে রাহওয়াই র.

-ঈমাম বুখারী ২৩ বছর বয়সে এই হাদীস রচনার কাজ শুরু করেন।

-এই গ্রন্থের কাজ শেষ করতে তার ১৬ বছর সময় লেগেছিল।

-এই গ্রন্থে মোট হাদিস: ৭২৭৫ মতান্তরে ৭০৫৩, অধ্যায়: ৯৮ মতান্তরে ৮৬, অনুচ্ছেদ: ৩৪৫০

-বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থঃ ফাতহুল বারী (ইবনে হাজার আসকালানী), উমদাদুল ক্বারী (বদরুদ্দীন আইনী), মিন্নাতুল বারী (আবদুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক), ফয়জুল বারী (আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী)

-এই গ্রস্থ রচনায় ঈমাম বুখারীর সাধনা ও সতর্কতা

-ঈমাম বুখারী সম্পর্কে কিছু কথা


হাদিসের ব্যাখ্যাঃ

১ম অংশঃ

-হাদিসের রাবী খাব্বার নিজেই নির্যাতনের স্বীকার, তাই রাসুলের কাছে তার প্রশ্নটি ছিল অভিযোগ স্বরূপ

-আল্লাহর রাসুল তো ছিলেন মুস্তাজাবুদ দাওয়া

-কিন্তু দ্বীনের পথ এতোটা কুসুমাস্তীর্ণ নয় (এই পথে সংগ্রাম বাধা সীমাহীন, ব্যাথাময় দুর্গম কষ্ট আঁধার)

-খাব্বার প্রশ্নের জবাবে রাসুলের উত্তরটি ছিল ধমকের সুরে

-অর্থাৎ এতো যুলুম-নির্যাতনের মুখেও খাব্বারের কথাটি রাসুল যেনো বরদাশত করছিলেন না


২য় অংশঃ

-তাই তিনি পূর্ববর্তীদের উদাহরণ টানলেন

-মাথার উপর করাত রাখা হয়েছিল জাকারিয়া আঃ

-ইয়াহিয়া আঃ কে শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল

-ইব্রাহিম আঃ কে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে (ইয়া নার কুনি বারদাও ও সালামুন আলা ইবৈাহিম)

-এর বর্তমান ফরমেশন হলো রিমান্ডে নির্যাতন (আয়নাঘরে বন্দি, ৫৭ দিনের রিমান্ড)

-শরীর থেকে গোশত আলাতা করা হয়েছে, অন্তর থেকে ঈমানাে আলাদা করা যায় নি

-ঈমান আলাদা হওয়ার বিষয় নয় (নফসি লি নফসিকাল ফিদায়ি ওজহি লি ওজজিকাল ফিদায়ি-তালহা রা. বলেছেন)

-ঈসা আঃ কে শূলে চড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে

-মুসা আঃ কে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে

-শূলে চড়ানোর বর্তমান ফরমেট হলো ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানো (মিশরের ইখওয়ান নেতা সাইয়েদ কুতুবের ফাঁসি, আফগান সিংহ ওমর মুখতারের ফাঁসি, আমাদের শীর্ষ ৫ নেতৃবৃন্দের ফাঁসি)

-আম্মার বিন ইয়াসির, তাঁর মাতা সুমাইয়া এবং তাঁর পরিবার। তারা আল্লাহর পথে কঠোর শাস্তি ভোগ করেছেন।

-যখন মরুর বালু উত্তপ্ত হয়ে উঠত তখন তাদেরকে চিৎ করে শায়িত করে শাস্তি দিত। সে অবস্থায় একদা রসূলুল্লাহ্ (ﷺ) তাঁদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলেছিলেন- ‘‘হে ইয়াসিরের পরিবার! ধৈর্য ধারণ করো, তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে জান্নাত।’’ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ইয়াসের ইন্তেকাল করেন।

-দুর্বৃত্ত আবু জাহল সুমাইয়া (রাঃ) এর লজ্জাস্থানে তীর দিয়ে আঘাত হানলে তৎক্ষণাৎ তিনি শাহাদত বরণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। -তারা আম্মারের উপরও শাস্তি কঠোর করে, কখনও তাকে তারা উত্তপ্ত রোদ্রে ফেলে শাস্তি দিত, কখনও ভারি প্রস্তর তার উপরে চাপিয়ে রাখতো, আবার কখনও আগুনে দগ্ধকরে শাস্তি দিত।

-বিলাল (রাঃ) উমাইয়া বিন খালফের দাস ছিলেন। উমাইয়া তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করত, উত্তপ্ত রৌদ্রে অভূক্ত অবস্থায় ফেলে রাখত। যখন দ্বি-প্রহরের কঠিন রোদে বালু উত্তপ্ত হয়ে উঠতো তখন তাকে মক্কার মরুভূমিতে নিয়ে যেত, অতঃপর চিৎ করে শুইয়ে তার বক্ষদেশে বিশাল একটি পাথর চাপিয়ে দিত। তখন তিনি বলতেন, আহাদ, আহাদ (আল্লাহ্ এক, আল্লাহ্ এক)।

-আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইনের ঈমান আনার ঘটনা

-হযরত যায়েদ বিন দাসানাকে বলা হয় “তোমার পরিবর্তে মুহাম্মদকে শুলে চড়ালে তুমি কি সহ্য করবে’’? তিনি জবাব দেন “তাঁকে শুলে চড়ানোতো দুরে কথা তাঁর পায়ে কাটার ফোঁটাও সহ্য করবোনা’’। এ কথা শোনার পর তাঁর উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয় ফলে তিনি শহীদ হয়ে যান। 

৩য় অংশঃ

-হযরত হামজার কলিজা চিবিয়ে খাওয়া হয়েছে। (উহুদের প্রান্তরে হামযার মত করে...)

-স্বয়ং রাসুলুল্লাহ নিজে দ্বীনের পথে সম্মুখীন হয়েছেন নানা নির্যাতনের (করদিয়া জঙ্গে...)


-আম হাসিবতুম আন তাদখুলুল জান্নাহ ওলাম্মা ইয়াতিকুম মাসালুল্লাযিনা...(বাকারা-২১৪)

-মুয়াজ ইবনে জাবালের হাদিস (নুশিরু বিল মিনশার ও হুমিলু আলাল খুশফ, মাওতুন ফি ত্বয়াতিল্লাহি খাইরুম মিনাল হায়াত ফি মাসিয়াতিল্লাহ)

-এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পরিক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন নবীরা (আশাদ্দুন্নাসি বালাগিল আম্বিয়া...ও ইন কানা ফি দ্বীনিহি জালাবুাতুন জুইয়িদা ফিল বালাগ)

-তাওহীদ কি আমানত সিনো মেহে হামারে, আসা নেহি মিটানা নাম নিশা হামারা-আল্লামা ইকবাল

-দাওয়াতের পথে যুলুম নির্যাতনও এক ভয়ংকর দাওয়াত (অধ্যাপক মফিজুর রহমান)

-কুরআন প্রতিষ্ঠার কাজ এতো সহজ নয় (ইন্না সানুলকি আলাইকা কাওলান সাকিলা-সুরা মুযযামামিল)

-ইনকিলাব বাচ্চুকা খেল নেজি (মাওলানা মওদুদী)

-Cowards die many times before their death, but the valiant never taste of death but once [Julius Caeser: Williams Shakespeare]

-এই পথের নির্যাতন হচ্ছে পৃথিবীর প্রসব বেদনা, এই কষ্টের পর যে শিশু প্রসব করবে তার নাম ইসলাম (আল্লামা সাঈদী)

-পরিক্ষা হয় যতই কঠিন পুরস্কারও হয় ততই মূল্যবান (মল্লিকের গান/এটা হাদিসেরও কথা)

-Take pain, be perfect [Williams Shakespeare]

-যত যাবে রক্ত তত হবো শক্ত (আম্দের স্লোগান)

-কাশেসু আসহাবে কাহফে লুহুরা, হেফজু করদে ইয়াসু কাশতে নূহুরা (আল্লামা ইকবাল)

-আল্লাহ কাউকে ভালোবাসলে পরিক্ষা করেন, আর কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তাকে গুনাহে নিপতিত করেন (হাদিস)

-শহীদ আবদুল মালেকের জানাযায় এসে মাওলানা বলেছিলেন, 'আঃ মালেক বাংলার প্রথম শহীদ, শেষ শহীদ নয়'

-মাগরিব মে ওয়াজিয়ু মে গুজে আজা হামারে, তানথা নাথা কিসিসে সইলে রুইয়া হামারা (আল্লামা ইকবাল)

-দাস্ত তো দাস্ত হায় দরিয়া বি না ছোড় হামনে (আল্লামা ইকবাল)


৪র্থ অংশঃ

-এখানে 'ওল্লাহে' শব্দ দিয়ে শপথ করা হয়েছে (তিন ভাবে শপথ হয়-ওল্লাহে, বিল্লাহে, তাল্লাহে)

-মুমিনদের আল্লাহ ছাড়া কারো নামে শপথ করা যাবে না (আল্লাহ তার সৃষ্টির নামে শপথ করেন)

-'সানা' হচ্ছে ইয়ামেনের রাজধানী

-'হাজরামাউত' হলো পূর্ব ইয়ামেন, পশ্চিম ওমান ও দক্ষিণ সৌদি আরবের কিছু অংশ (আরব রাষ্ট্র)

-ইন্দোনেশিয়া জাকার্তা থেকে মরক্কোর রাবাত পর্যন্ত শাসনের কথা বলতেন সাঈদী হুজুর

-একাকিনী রমনী নির্জন পথে যাবে কোনদিন কটু কথা কবে না, কোনদিন পথে ঘাটে সম্পদের মোহে খুন আর রাহাজানি হবে না (গানের লাইন)

-Within 1 century the whole Europe particularly England will have no choice to embrace ISLAM. [Nechellson]

-তাড়াহুড়ো না করে ধৈর্য ধারন করতে হবে (এ আকাশ মেঘে ঢাকা রবে না আলোয় আলোয় হেসে উঠবে, এ নদী গতিহীন হবে সাগরের পানে শুধু ছুটবে-কবি মল্লিক)


শিক্ষাঃ
১. ইসলামী আন্দোলনের জন্য পূর্ববর্তীদের ত্যাগ কুরবানির ইতিহাস স্মরণ করা উচিত।
২. এই জমিনে অবশ্যই দ্বীন প্রতিষ্ঠা হবে সে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধারন করা দরকার।
৩. সকল যুলুম নির্যাতনের মুখে দ্বীনের উপর অটল অবিচল থাকা মুমিনদের বাঞ্ছনীয়।

সুরা নিসা (আয়াতঃ ৭১-৭৬)

সুরা পরিচিতিঃ

সুরার নাম- আন নিসা (سورة النساء)

সুরার অর্থ- মহিলা

সুরা নম্বর- ৪ (চতুর্থ)

আয়াত সংখ্যা- ১৭৬টি 

রুকুর সংখ্যা- ২৪টি

পারা- ৪ থেকে ৬

অবতীর্ণ- মদিনা

পূর্ববর্তী সুরা- আলে ইমরান

পরবর্তী সুরা- মায়েদা


নামকরণঃ

এই সুরার বিভিন্ন আয়াতে মোট ১৬ বার "নিসা" শব্দটি রয়েছে। যেমন:

১ নং আয়াতে, 'ও বাসসা মিন হুমার রিজালান কাসিরাও ও নিসায়া'

৩ নং আয়াতে, 'ফানকিহু মা ত্ববালাকুম মিনান নিসা'

৪ নং আয়াতে, 'ও আতুন নিসায়া সুদুকাতিহিন্না নিজলাহ'

৩৪ নং আয়তে, 'আর রিজালুন কাওয়ামুনা আলান নিসা'

৭৫ নং আয়াতে, 'ওল মুসতাদ আফিনা মিনার রিজালি ওন নিসা'

কুরআনের অন্যান্য সুরাতেও 'নিসা' শব্দটি রয়েছে-

আলে ইমরানের ১৪ নং আয়াতে, 'হুব্বুশ শাহাওয়াতি মিনান নিসা'

সেই হিসেবে সুরার নাম দেয়া হয়েছে 'আন নিসা' যার অর্থ মহিলা/নারী/স্ত্রীলোক/রমনী/Female/Women/Lady 

[নারী সম্পর্কে কিছু কথা]

কুরআনে এর কাছাকাছি ব্যবহৃত শব্দরূপ- 

✔ 'ইমরাত' 

ও দারাবাল্লাহু মাসালান লিল্লাযিনা আমানু ইমরাতা* ফিরআউন [সুরা তাহরিম:১১] 

✔ 'ইনাসা' 

ইয়া হাবু লি মাইয়াশায়ু ইনাসাও* ও ইয়া হাবু লি মাইয়াশায়ু জুকুরা, আও ইয়ু যাও ইজুহুম জুকরাও ও ইনাসাও* ও ইয়াজয়ালু মাইয়াশায়ু আকিমা [সুরা শূরা: ৪৯-৫০]

✔ 'জাওজ'

ইয়া আদম উসকুন আনতা ও জাওজুকাল* জান্নাতা [বাকারা: ৩৫]

রাব্বানা হাবলানা মিন আজওয়াজিনা* ওয়া জুররিয়া তিনা কুররাতা আইয়ুন [ফুরকান: ৭৪]


আনুষাঙ্গিক বিষয়ঃ

এই সুরা শুরু হয়েছে 'ইয়া আইয়ুহান নাস' দিয়ে।

এই শব্দ দিয়ে কুরআনে আরো একটি সুরা শুরু হয়েছে। ২২ নং সুরা হাজ্জ্ব।


নাযিল হওয়ার সময়কালঃ

এ সূরাটি কয়েকটি ভাষণের সমষ্টি। সম্ভবত তৃতীয় হিজরীর শেষের দিক থেকে নিয়ে চতুর্থ হিজরীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম হিজরীর প্রথম দিকের সময়-কালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন অংশ নাযিল হয়। 


আমরা জানি উত্তরাধিকার বন্টন ও এতিমদের অধিকার সম্বলিত বিধানসমূহ ওহোদ যুদ্ধের পর নাযিল হয়। তখন সত্তর জন মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনাটির ফলে মদীনার ছোট জনবসতির বিভিন্ন গৃহে শহীদদের মীরাস কিভাবে বন্টন করা হবে এবং তারা যেসব এতিম ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন তাদের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরই ভিত্তিতে আমরা অনুমান করতে পারি, প্রথম চারটি রুকু, ও পঞ্চম রুকূর প্রথম তিনটি আয়াত এ সময় নাযিল হয়ে থাকবে।


যাতুর রিকা'র যুদ্ধে সালাতুল খওফ (যুদ্ধ চলা অবস্থায় নামায পড়া) পড়ার রেওয়ায়াত আমরা হাদীসে পাই। এ যুদ্ধটি চতুর্থ হিজরীতে সংঘটিত হয়। তাই এখানে অনুমান করা যেতে পারে, যে ভাষণে (১৫ রুকূ) এ নামাযের নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে সেটি এরই কাছাকাছি সময়ে নাযিল হয়ে থাকবে। 


চতুর্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মদীনা থেকে বনী নযীরকে বহিষ্কার করা হয়। তাই যে ভাষণটিতে ইহুদীদেরকে এ মর্মে সর্বশেষ সর্তকবাণী শুনিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, আমি তোমাদের চেহারা বিকৃত করে পেছন দিকে ফিরিয়ে দেবার আগে ঈমান আনো, সেটি এর পূর্বে কোন নিকটতম সময়ে নাযিল হয়েছিল বলে শক্তিশালী অনুমান করা যেতে পারে।


বনী মুসতালিকের যুদ্ধের সময় পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর এ যুদ্ধটি পঞ্চম হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল। তাই যে ভাষণটিতে (৭ম রুকু) তায়াম্মুমের কথা উল্লেখিত হয়েছিল সেটি এ সময়ই নাযিল হয়েছিল মনে করতে হবে।


নাযিলের উপলক্ষ/প্রেক্ষাপটঃ

এভাবে সামগ্রিক পর্যায়ে সূরাটি নাযিল হওয়ার সময়-কাল জানার পর আমাদের সেই যুগের ইতিহাসের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়া উচিত। এর সাহায্যে সূরাটি আলোচ্য বিষয় অনুধাবন করা সহজসাধ্য হবে।


নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে সে সময় যেসব কাজ ছিল সেগুলোকে তিনটি বড় বড় বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। 

১. একটি নতুন ইসলামী সমাজ সংগঠনের বিকাশ সাধন। হিজরতের পরপরই মদীনা ও তার আশেপাশের এলাকায় এ সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের পুরাতন পদ্ধতি নির্মূল করে নৈতিকতা, তামাদ্দুন, সমাজরীতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা নতুন নীতি-নিয়ম প্রচলনের কর্মতৎপরতা এগিয়ে চলছিল। 

২. আরবের মুশরিক সম্প্রদায়, ইহুদী গোত্রসমূহ ও মুনাফিকদের সংস্কার বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে ইসলামের যে ঘোরতর সংঘাত চলে আসছিল তা জারী রাখা। 

৩. এ বিরোধী শক্তিগুলোর সকল বাধা উপেক্ষা করে ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকা এবং এ জন্য আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সেখানে ইসলামকে বিজয়ীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করা।


আলোচ্য বিষয়ঃ

ইসলামের সামাজিক কাঠামো নির্মাণ এবং বাস্তবে এ সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম অবস্থায় যে সমস্ত নির্দেশ ও বিধানের প্রয়োজন ছিল সূরা বাকারায় সেগুলো প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমানে এ সমাজ আগের চাইতে বেশী সম্প্রসারিত হয়েছে। কাজেই এখানে আরো নতুন নতুন বিধান ও নির্দেশের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। 


১. পরিবার গঠনের নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। বিয়েকে বিধি-নিষেধের আওতাধীন করা হয়েছে। 

২. সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। 

৩. এতিমদের অধিকার নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মীরাস বন্টনের নিয়ম-কানুন নির্ধারিত হয়েছে। 

৪. অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

৫. ঘরোয়া বিবাদ মিটাবার পদ্ধতি শিখানো হয়েছে। 

৬. অপরাধ দণ্ডবিধির ভিত গড়ে তোলা হয়েছে। 

৭. মদপানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। 

৮. তাহারাত ও পাক-পবিত্রতা অর্জনের বিধান দেয়া হয়েছে। 

৯. আল্লাহ ও বান্দার সাথে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষের কর্মধারা কেমন হতে পারে, তা মুসলমানদের জানানো হয়েছে। 

১০. মুসলমানদের মধ্যে দলীল সংগঠন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে। 

১১. আহলি কিতাবদের নৈতিক, ধর্মীয় মনোভাব ও কর্মনীতি বিশ্লেষণ করে মুসলমানদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন পূর্ববর্তী উম্মতদের পদাংক অনুসরণ করে চলা থেকে বিরত থাকে। 

১২. মুনাফিকদের কর্মনীতির সমালোচনা করে যথার্থ ও খাঁটি ঈমানদারীর এবং ঈমান ও নিফাকের পার্থক্য সূচক চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে রেখে দেয়া হয়েছে। 

১৩. ইসলাম বিরোধী শক্তিদের সাথে যে সংঘাত চলছিল ওহোদ যুদ্ধের পর তা আরো নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল। ওহোদের পরাজয় আশপাশের মুশরিক গোত্রসমূহ, ইহুদী প্রতিবেশীবৃন্দ ও ঘরের শক্র বিভীষণ তথা মুনাফিকদের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলমানরা সবদিক থেকে বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিকে আবেগময় ভাষণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করলেন এবং অন্যদিকে যুদ্ধাবস্থায় কাজ করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। 

১৪. মদীনায় মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার লোকেরা সব ধরনের ভীতি ও আশংকার খবর ছড়িয়ে হতাশা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। এ ধরনের প্রত্যেকটি খবর দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার এবং কোন খবর সম্পর্কে পুরোপুরি অনুসন্ধান না করার আগে তা প্রচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার নির্দেশ দেয়া হয়।

১৫. মুসলমানদের বারবার যুদ্ধে ও নৈশ অভিযানে যেতে হতো। অধিকাংশ সময় তাদের এমন সব পথ অতিক্রম করতে হতো যেখানে পানির চিহ্নমাত্রও পাওয়া যেতো না। সে ক্ষেত্রে পানি না পাওয়া গেলে অযু ও গোসল দুয়ের জন্য তাদের তায়াম্মুম করার অনুমতি দেয়া হয়। 

১৬. এছাড়াও এ অবস্থায় সেখানে নামায সংক্ষেপে করারও অনুমতি দেয়া হয়। 

১৭. আর যেখানে বিপদ মাথার ওপর চেপে থাকে সেখানে সালাতুল খওফ (ভয়কালীন নামায) পড়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়। 

১৮. আরবের বিভিন্ন এলাকায় যেসব মুসলমান কাফের গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং অনেক সময় যুদ্ধের কবলেও পড়ে যেতো, তাদের ব্যাপারটি ছিল মুসলমানদের জন্য অনেক বেশী পেরেশানির কারণ। এ ব্যাপারে একদিকে ইসলামী দলকে বিস্তারিত নির্দেশ দেয়া হয় এবং অন্যদিকে ঐ মুসলমানদেরকেও সবদিক থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে সমবেত হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

১৯. ইহুদীদের মধ্যে বিশেষ করে বনী নাযীরের মনোভাব ও কার্যধারা অত্যন্ত বিরোধমূলক ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তারা সব রকমের চুক্তির খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণ করে ইসলামের শক্রদের সাথে সহযোগিতা করতে থাকে এবং মদীনায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে। তাদের এসব কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরকে সর্বশেষ সতর্কবাণী শুনিয়ে দেয়া হয় এবং এরপরই মদীনা থেকে তাদের বহিষ্কারের কাজটি সমাধা করা হয়।

২০. মুনাফিকদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে। কোন ধরনের মুনাফিকদের সাথে কোন ধরনের ব্যবহার করা হবে, এ সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাই এদের সবাইকে আলাদা আলাদা শ্রেণীতে বিভক্ত করে প্রত্যেক শ্রেণীর মুনাফিকদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তা বলে দেয়া হয়েছে। 

২১. চুক্তিবদ্ধ নিরপেক্ষ গোত্রসমূহের সাথে মুসলমানদের কোন ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তাও সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। 

২২. মুসলমানদের নিজেদের চরিত্রকে ত্রুটিমুক্ত করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এ সংঘাত সংঘর্ষে এ ক্ষুদ্র দলটি একমাত্র নিজের উন্নত নৈতিক চরিত্র বলেই জয়লাভ করতে সক্ষম ছিল। এছাড়া তার জন্য জয়লাভের আর কোন উপায় ছিল না। তাই মুসলমানদেরকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। 

২৩. তাদের দলের মধ্যে যে কোন দুর্বলতা দেখা দিয়েছে কঠোর ভাষায় তার সমালোচনা করা হয়েছে।

২৪. ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের দিকটিও এ সূরায় বাদ যায়নি। জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় ইসলাম দুনিয়াকে যে নৈতিক ও তামাদ্দুনিক সংশোধনের দিকে আহবান জানিয়ে আসছিল, তাকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করার সাথে সাথে এ সূরায় ইহুদী, খৃস্টান ও মুশরিক এ তিনটি সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণা-বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তাদের সামনে একমাত্র সত্য দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়েছে।


নির্ধারিত অংশের ব্যাখ্যাঃ

আয়াত নং :-৭১

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا خُذُوْا حِذْرَكُمْ فَانْفِرُوْا ثُبَاتٍ اَوِ انْفِرُوْا جَمِیْعًا

হে ঈমানদারগণ! মোকাবিলা করার জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকো।(১০১) তারপর সুযোগ পেলে পৃথক পৃথক বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে বের হয়ে পড়ো অথবা এক সাথে।


টিকা:১০১) উল্লেখ্য এ ভাষণটি এমন এক সময় নাযিল হয়েছিল যখন ওহোদ যুদ্ধের পরাজয়ের পর মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকার গোত্রগুলোর সাহস বেড়ে গিয়েছিল এবং বিপদ আপদ চতুর্দিক থেকে মুসলমানদেরকে ঘিরে ফেলেছিল। সে সময় প্রায় প্রতিদিনই নানান ধরনের দুঃসংবাদ আসতো। উমুক গোত্র বিরূপ হয়ে গেছে। মুসলমানদের সাথে এক নাগাড়ে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছিল। তাদের প্রচারকদেরকে দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে দাওয়াত দিয়ে ধোঁকা দিয়ে হত্যা করা হতো। মদীনার বাইরে তাদের জানমালের কোন নিরাপত্তা ছিল না। এ অবস্থায় এসব বিপদের ঢেউয়ের আঘাতে যাতে ইসলামের তরী ডুবে না যায় সেজন্য মুসলমানদের পক্ষ থেকে একটি জোরদার প্রচেষ্টা ও জীবন উৎসর্গকারী সংগ্রাম পরিচালনার প্রয়োজন ছিল।


আয়াত নং :-৭২

وَ اِنَّ مِنْكُمْ لَمَنْ لَّیُبَطِّئَنَّ ۚ فَاِنْ اَصَابَتْكُمْ مُّصِیْبَةٌ قَالَ قَدْ اَنْعَمَ اللّٰهُ عَلَیَّ اِذْ لَمْ اَكُنْ مَّعَهُمْ شَهِیْدًا

হ্যাঁ, তোমাদের কেউ কেউ এমনও আছে যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে গড়িমসি করে।(১০২) যদি তোমাদের ওপর কোন মুসিবত এসে পড়ে তাহলে সে বলে আল্লাহ‌ আমার প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করেছেন, আমি তাদের সাথে যাইনি।


টিকা:১০২) এর এক অর্থ এও হতে পারে যে, নিজে তো গড়িমসি করেই, এমন কি অন্যদেরকেও হিম্মতহারা করে দেয়, তাদের বুকে ভয় ঢুকিয়ে দেয় এবং জিহাদ বন্ধ করার জন্য এমন ধরনের কথা বলতে থাকে যার ফলে তারা নিজেদের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকে।


আয়াত নং:- ৭৩

وَ لَئِنْ اَصَابَكُمْ فَضْلٌ مِّنَ اللّٰهِ لَیَقُوْلَنَّ كَاَنْ لَّمْ تَكُن ۢ ْ بَیْنَكُمْ وَ بَیْنَهٗ مَوَدَّةٌ یّٰلَیْتَنِیْ كُنْتُ مَعَهُمْ فَاَفُوْزَ فَوْزًا عَظِیْمًا

আর যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়, তাহলে সে বলে—এবং এমনভাবে বলে যেন তোমাদের ও তার মধ্যে কোন প্রীতির সম্পর্ক ছিলই না,-হায়! যদি আমিও তাদের সাথে হতাম তাহলে বিরাট সাফল্য লাভ করতাম।


আয়াত নং :-৭৪

فَلْیُقَاتِلْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ الَّذِیْنَ یَشْرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَا بِالْاٰخِرَةِ ؕ وَ مَنْ یُّقَاتِلْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ فَیُقْتَلْ اَوْ یَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِیْهِ اَجْرًا عَظِیْمًا

(এই ধরনের লোকদের জানা উচিত) আল্লাহর পথে তাদের লড়াই করা উচিত যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিকিয়ে দেয়।(১০৩) তারপর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়বে এবং মারা যাবে অথবা বিজয়ী হবে তাকে নিশ্চয়ই আমি মহাপুরস্কার দান করবো।


টিকা:১০৩) অর্থাৎ আল্লাহর পথে লড়াই করা দুনিয়ার লাভ ও দুনিয়ার স্বার্থ পূজারী লোকদের কাজ নয়। এটা এমন এক ধরনের লোকের কাজ যারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করে, যারা আল্লাহ‌ ও আখেরাতের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখে এবং নিজেদের পার্থিব প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির সমস্ত সম্ভাবনা ও সব ধরনের পার্থিব স্বার্থ একমাত্র আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তাদের রব যেন তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং এই দুনিয়ায় তাদের ত্যাগ কুরবানী বিফল হয়ে গেলেও আখেরাতেও যেন বিফলে না যায়।


আয়াত নং :-৭৫

وَ مَا لَكُمْ لَا تُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ الْمُسْتَضْعَفِیْنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الْوِلْدَانِ الَّذِیْنَ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا مِنْ هٰذِهِ الْقَرْیَةِ الظَّالِمِ اَهْلُهَا ۚ وَ اجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ وَلِیًّا ۙ ۚ وَّ اجْعَلْ لَّنَا مِنْ لَّدُنْكَ نَصِیْرًاؕ 

তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নরনারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরী করে দাও।(১০৪)


টিকা:১০৪) এখানে এমন সব মজলুম শিশু, নারী ও পুরুষদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যারা মক্কায় ও আরবের অন্যান্য গোত্রের মধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু তাদের হিজরত করার শক্তি ছিল না এবং নিজেদেরকে কাফেরদের জুলুম-নির্যাতন থেকে রক্ষা করার ক্ষমতাও ছিল না। এদের ওপর বিভিন্ন প্রকার জুলুম চালানো হচ্ছিল। কেউ এসে তাদেরকে এই জুলুমের সাগর থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে, এই ছিল তাদের দোয়া ও প্রত্যাশা।


আয়াত নং :-৭৬

اَلَّذِیْنَ اٰمَنُوْا یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ ۚ وَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا یُقَاتِلُوْنَ فِیْ سَبِیْلِ الطَّاغُوْتِ فَقَاتِلُوْۤا اَوْلِیَآءَ الشَّیْطٰنِ ۚ اِنَّ كَیْدَ الشَّیْطٰنِ كَانَ ضَعِیْفًا۠

যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে।(১০৫) কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ো এবং নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের কৌশল আসলে নিতান্তই দুর্বল।(১০৬)


টিকা:১০৫) এটি আল্লাহর একটি দ্ব্যর্থহীন ফায়সালা। আল্লাহর পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে লড়াই করা হচ্ছে ঈমানদারদের কাজ। যথার্থ ও সত্যিকার মু’মিন এই কাজ থেকে কখনো বিরত থাকবে না। আর আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহ বিরোধী ও আল্লাহদ্রোহীদের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাগুতের পথে লড়াই করা হচ্ছে কাফেরদের কাজ। কোন ঈমানদার ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে না।


টিকা:১০৬) অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে শয়তান ও তার সাথীরা বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে আসে এবং জবরদস্ত কৌশল অবলম্বন করে কিন্তু তাদের প্রস্তুতি ও কৌশল দেখে ঈমানদারদের ভীত হওয়া উচিত নয়, অবশ্যি তাদের সকল প্রস্তুতি ও কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।


হযরত আবদুল্লাহ যুল বাজাদাইন (রা:) এর শাহাদাতের মর্যাদা সংক্রান্ত হাদীস

 



(সীরাতে ইবনে হিশাম ৫২)

অনুবাদ:

তিনি (ইবনে ইসহাক) বলেন, আমার নিকট মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম বিন আল হারিস আত তাইমি (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বর্ননা করেছেন। তিনি বলেন, আমি তাবুক অভিযানে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সাথে থাকাকালিন সময়ে একদিন মাঝরাতে জেগে উঠলাম। সহসা দেখলাম সেনা শিবিরের একপাশে আগুনের শিখা । আমি ঘটনাটি দেখার জন্য সেই শিখার কাছে চলে গেলাম। সেখানে যেয়ে দেখি, রাসুলুল্লাহ (সঃ), আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ও ওমর ফারুক (রাঃ) উপস্থিত। আরও দেখি, আব্দুল্লাহ জ্বল বিজাদাইন আল মুজনী ইন্তেকাল করেছেন, তাঁরা তাঁর জন্য কবর খনন করছেন । রাসূলুল্লাহ (সা) কবরের ভিতরে এবং আৰু বকর সিদ্দিক (রা) ওমর ফারুক (রা) তাঁর লাশ কবরের ভিতরে রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট নামিয়ে দিচ্ছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলছিলেন, তোমাদের ভাই (আব্দুল্লাহ জুল বিজাদাইন) কে আমার নিকটবর্তী করে দাও। তাঁরা তাঁকে কবরের ভিতরে নামিয়ে দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাকে পাশ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। করলেন, তখন বললেন, হে আল্লাহ! আমি আজ রাত পর্যান্ত তার উপর খুশী ছিলাম। অতএব তুমিও তার প্রতি রাজি-খুশি থাকো ।

আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ(রাঃ) বললেন, হায়! আমি যদি এই কবরের বাসিন্দা হতাম। ইবনে হিশাম বলেন, তাঁর নাম জুল বিজাদাইন হওয়ার কারণ এই ছিল যে, তিনি ইসলামের দিকে এগিয়ে আসছিলেন, তখন তাঁর গোত্র তাঁকে এর থেকে বাধা দেয় তারা তাঁকে বিভিন্ন ভাবে কষ্ট দিতে থাকে। শেষ পর্যান্ত তারা তাঁকে বিজ্ঞাদ পরিয়ে ছেড়ে দেয়।


বিজ্ঞাদ অর্থ মোটা খসখসে কম্বল। তিনি সেই অবস্থায় তাদের হাত থেকে পালিয়ে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট চলে আসেন। তঁনি যখন রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট পৌঁছান তখন তিনি কম্বলটি দুই টুকরা করে এক টুকরা পরিধান করেন এবং অন্য টুকরা গায়ে জড়িয়ে নেন। তারপর রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সম্মুখে উপস্থিত হন। এজন্য তাকে জুল বিজ্ঞাদাইন (দুই টুকরা কম্বল জড়ানো) নামে নামকরণ করা হয়। বিজাদ শব্দের আর একটি অর্থ চট। ইবনে হিশাম কবি ইমরুল কায়েসের কবিতা উদ্ধতি পেশ করেছেন।

অর্থ-প্রথম বৃষ্টির মধ্যে আবান পাহাড় যেন চট জড়ানো এক বিশাল মানুষ।

এই কবিতায় বিজ্ঞান অর্থ চট। বিজ্ঞাদাইন অর্থ দুই টুকরা চট জড়ানো।


আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) এর পরিচিতিঃ

তিনি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর প্রসিদ্ধ ১ম স্তরের সাহাবি। ৬ষ্ঠ ইসলাম গ্রহনকারী বলে উল্লেখ করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর ১৪ বছরের ছোট । ৫৯৪ খৃষ্টাব্দে তামিম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেণ তিনি কুফার কাজী হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি ৬৫০ খৃষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।

তিনি কুরাইশ দের সর্বপ্রথম কুরআনের সূরা রহমান তেলাওয়াত করে শুনান। যার কারনে তিনি ব্যাপক প্রহৃত হন। তিনি বলেছেন, তারা আমার নিকট তখন অতিতুচ্ছ মনে হচ্ছিল। অনুমতি দিলে আমি আবার তাদেরকে তেলাওয়াত শুনাব।

তিনি কুরাইশ নেতা উকবা বিন আবু মুআইত এর ছাগল চরাতেন। দুইজন ব্যাক্তি তার নিকট ছাগলের দুধ পান করতে চান।তিনি বলেন, আমি এই ছাগলের মালিক নই। তার আমানত দারিতে ঐ দুই জন খুশি হন। পাঁঠার সংস্পর্শে যায়নি এমন ছাগল দেখিয়ে দিতে বলেন। দেখিয়ে দিলে একজন সেই ছাগলের বাটে স্পর্শ করলে কিছু দুধ জমা হয়। তা উভয়ে পান করেন এবং আব্দুল্লাহ বিন মাসউদকে পান করতে দেন। তিনি (আব্দুল্লাহ বিন। মাসউদ) বিস্মিত হন এবং পান করেন। এই দুই জন ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সঃ) এবং আবু বক্কর সিদ্দিক (রাঃ)। অল্প দিনের মধ্যে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) এর খাদেমে পরিণত হন রাসূলুল্লাহ (সা) জুতা মেসওয়াক ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য তাঁর সাথে বহন করতেন বাহিরে ও বাড়িতে তাঁর সঙ্গী হিসেবে অবস্থান করতেন।

হযরত ওমর (রা) ২০ হিজরি সনে তাঁকে কুফার কাজী নিয়োগ করেন। দীর্ঘ দশ বছর তিনি আব্দুল্লাহ বিন

মাসউদ (রা)] এই দায়িত্ব পালন করেন। হযরত ওসমান (রা) এর খেলাফতের ১ম অর্ধেকের পর এই দায়িত্ব থেকে তিনি অব্যহতি পান । তার পর মদীনায়

অবস্থান করতে থাকেন। ৩২/৩৩ হিজরি সনে তিনি ইন্তিকাল করেন। তিনি কুফা থেকে আসার পথে আবু জার গিফারী (রা) এর ইন্তিকালের পর তার জানাযা পড়ান।

الله اعلم بالصواب --রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নামাযের কিরাত শ্রবণ করেন। এবং প্রশংসা করেন।তিনি ১৯৮৯ টি হাদিস বর্ণনা করেন।

গ্রন্থাকার পরিচিতিঃ

ইবনে হিশামের পরিচয়ঃ

আবু মুহাম্মাদ 'আবদ আল-মালিক বিন হিশাম বা ইবনে হিশাম একজন বিখ্যাত ও প্রাচীন সীরাত সংকলক। তিনি ইবনে ইসহাকের সংকলিত সীরাত বা মুহাম্মদ(সা.) এর জীবনীকে পুনর্সম্পাদনা করেন যা সিরাতে ইবনে হিশাম নামে পরিচিত। ইবনে ইসহাকের সীরাতটি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ইবনে হিশাম ও আল তাবারীর পরিবর্তিত সংষ্করণে এটি এখনো জীবিত আছে। বর্তমানে তার সীরাত গ্রন্থকে প্রামণ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

ইবনে হিশাম বসরায় তার শৈশবকাল অতিবাহিত করেন এবং পরবর্তীতে মিশরে চলে আসেন।

তার কাজঃ

আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়াহ, ইবনে ইসহাকের সীরাতের সম্পাদিত সংস্করণ (অনুরুপ নয়)।
এছাড়াও তিনি দক্ষিণ আরবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন যার নাম "কিতাব আল-তিজান লি মা'রিফাতি মুলুক আল-জামান" (রাজমুকুটের বই, যুগের সম্রাটদের জানার জন্য)

মৃত্যুঃ

২১২/২১৮ এ.এইচ/৮২৮ অথবা ৮৩৩ এ.ডি


হাদিসের সংঙ্গা ও প্রকারভেদ:

১/ কওলী, ফেনী ও তাকরীরী 

২/ মারফু, মাওকুফ ও মাকতু। 

৩/মুতাওতির মাশহুর আজীজ গারিব। 

৫/মুনকাতি,মুআদাল মুআল্লাক মুরসাল।

-পেশকৃত হাদীসটি মওকুফ/হাসান/যয়ীফ।


ব্যাখ্যা:

১. ইসলাম গ্রহনের পূর্বে তার নাম ছিল আব্দুল উজ্জা আল মুজানি । মুজাইনা গোত্রে জন্য গ্রহণ করায় তাকে মুজানি বলা হয়। তিনি ১৬ বৎসর বয়সে ইসলাম গ্রহন করেন। তিনি তাঁর জীবনে খুবই ঐসয্যের অধিকারী ধনী যুবক ছিলেন। তিনি ছোট থাকতে তাঁর পিতা মাতা উভয়ে ইন্তিকাল করেন।

তাঁর চাচা তাকে লালন পালন করেন । তিনি যুবকদের মধ্যে বিবেচনা সম্পন্ন যুবক ছিলেন। তিনি উন্নত, মুল্যবান ও সৌন্দয্য মন্ডিত পোষাক পরিধান করতেন সিরিয়া থেকে তার উদ্দেশ্য যে সকল মূল্যবান পোষাক। পরিচ্ছেদ নিয়ে আসা হতো, তিনি সেই পোষাক পরিধান করতেন। মুজাইনা গোত্রে যে সময় একটি ছোট খচ্ছরের মালিক যুবককে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ মনে করা হতো সে সময় তিনি একমাত্র যুবক ছিলেন, যিনি অনেক ঘোড়ার মালিক ছিলেন। তার চাচা মুজাইনা গোত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন ।


তাঁর ইসলাম গ্রহন সর্বোত্তম ও বিস্ময়কর ঘটনা-

তাঁর বয়স যখন ১৬ বৎসর পূর্ণ হয়, সেই সময় সাহাবীগণ (রা) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে চলে যেতে শুরু করেন। তারা হিজরত করার পথে সুজাইনা গোত্রের উপর দিয়ে অতিক্রম করতেন। তারা খুব দ্রুত অতিক্রম করতেন। কেননা কুরাইশ কাফেররা তাদের সাথে মিলিত হয়ে ধরার সম্ভবনা ছিলো। একদিন একজন সাহাবীর হিজরত করার মধ্যে তার মুখোমুখী হন এবং তার নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। তিনি তৎক্ষনাৎ ইসলাম কবুর করেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি তাদের নিকট পবিত্র কুরআন থেকে কিছু শিক্ষা দেয়ার আবেদন করেন। তারা বললেন, আমরা তোমার সাথে সময় দিতে পারবো না। কেননা কুরাইশরা আমাদের ধরে ফেলতে পারে। তবে তুমি যদি কুরআন শিখতে ইচ্ছা কর, তাহলে আমাদের সাথে রাস্তায় মিলিত হয়ে শিক্ষা গস্খহনকরতে পারো। তিনি তাদের পিছনে পায়ে হেটে চলতে লাগলেন। তাঁরা কুরআন তেলাওয়াত করতেন আর তিনি তাদের পিছনে ১৫ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব পর্যন্ত যেয়ে কুরআন তেলোওয়াত শিক্ষা করতেন।তারপর মুজাইনা গোত্রে ফিরে আসতেন। পরবর্তী দিনে পুনরায় মুজাইনা গোত্রের সীমানায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করতেন, কোন সাহাবী হিজরতের পথে যায় কিনা? তখন তিনি তাকে বলতেন, আমাকে কিছু কুরআন শিক্ষা দাও। তাছাড়া গতদিন তিনি যেটুকু কুরআন হেফজ করেছেন, তা তার নিকট তিলাওয়াত করে। পড়ে শুনাতেন। তখনি তিনি কুরআনের একাধিক সূরা শিক্ষা লাভ করেন।

একদিন তাঁর নিকট একজন সাহাবী এসে বলেন, তুমি কেন আমাদের রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট হিজরত করছো না? তিনি বললেন, আমার চাচা ইসলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ত আমি হিজরত করতে চাচ্ছি না। যেহেতু। তিনি আমার লালন পালন করেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে আমি হিজরত করবো না।

মুজাইনা গোত্রে তিন বৎসর অতিবাহিত হলো। তিনি তার ইসলাম গ্রহণ কে গোপন রেখে ছিলেন। তার চাচার সাথে কথা বলার জন্য সময় ও সুযোগ মুজতে ছিলেন । তার কাছে যে মুহাম্মদ (সা) এর নিয়ে আসা নতুন স্বীন পৌঁছেছে, তা তার চাচা অবিহিত করাতে চান।তিনি প্রতিদিন চাচাকে দ্বীনের ব্যপারে দাওয়াত দিচ্ছিলেন এবং তার কথা শুনতে প্রতাখ্যান করতে ছিলেন।যখন তিনি নামাজ আদায় করতে ইচ্ছা করতেন তখন মরুভূমিতে বহু দূরে চলে যেতেন যাতে কেহ দেখতে না পায়। এই অবস্থায় তিন বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি চাচার নিকট যেয়ে বললেন, আমি অনেক বিলম্ব করেছি।হে চাচা। আপনি কি ইসলাম গ্রহণ করতে বিলম্ব করবেন?

আমি নবীর বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারছি না। আমি আপনাকে সংবাদ দিতে চাচ্ছি যে, আমি ৩ বৎসর যাবৎ কালিমায়ে তাওহীদ গ্রহণ করেছি। আমি এখন আল্লাহর রাসূলের নিকট হিজরত করছি।

আমি চাই যে, আপনি আমার সাথে থাকবেন। আপনি যদি ইসলাম গ্রহণ না করেন তাহলে হিজরত করতে আমাকে কোন বাধা দিতে পারবেন না। এ কথায় তার চাচা খুবই রাগান্বিত হয়ে বললেন। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করতে চাও তাহলে আমি তোমার মালিকানাধীন সকল সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে মুক্ত করে দিব । তখন তিনি বললেন, আপনার যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। আমি কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলুল্লাহ (সা) উপরে কোন কিছুই প্রাধান্য দিতে পারবো না। তখন চাচা বললেন, তুমি যদি ইসলামের উপর দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে আমি তোমাকে সব কিছু থেকে মুক্ত করলাম। এমনকি তোমার পরিধেয় বক্স ছিনিয়ে নিলাম। এরপর উঠে তার পরিহিত সকল পোশাক খুলে নিলেন। তখন আব্দুল্লাহ বললেন, হে আমার চাচা। আপনি আমার সাথে যে ব্যবহারই করেন না কেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, অবশ্যই আমি আল্লাহর রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকটে হিজরত করে চলে যাব।


মরুভূমিতে উলঙ্গের মতো অবস্থায় তার হিজরত শুরু হল। এমনকি নিজের খসখসে মোটা কম্বল দুই টুকরা করে এক টুকরা পরিধান করলেন আর এক টুকরা কম্বল গায়ে জড়িয়ে নিলেন। এমনকি যদিনায় পৌঁছে ফজরের নামাজ মসজিদে জমায়াতে আদায় করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) প্রতিদিনের অভ্যাস অনুযায়ী নতুন হিজরত করে আসা ব্যক্তিদের খোজ খবর নিতেন। সেদিন রাসূলুল্লাহ (সা) জুল বিজাদাইন কে দেখে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কে? আব্দুল্লাহ বললেন আমার নাম আব্দুল উজ্জা। তখন রাসূল (সা) বললেন, তুমি চটের মত এমন খসখসে কম্বল পরেছ কেন? তিনি বললেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি তাই আমার চাচা আমার মালিকানাধীন সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। এমনকি আমার পোশাক পরিচ্ছেদও। আমি পথে মোটা কম্বলের এই দুই টুকরা ছাড়া পরিধান করার আর কিছু পায়নি। তাই আমি আপনার কাছে কম্বলের দুই টুকরা পরিধান করেই উপস্থিত হয়েছি। রাসুলুল্লাহ (সঃ) বললেন, তোমার সাথে এই ব্যবহার করা হয়েছে? তিনি বললেন হ্যাঁ। তখন রাসুল (সঃ) উঠে বললেন আজ থেকে তোমার নাম আব্দুল্লাহ জুল বিজাদাইন, তোমার নাম আব্দুল উজ্জা নয়। আল্লাহ তোমাকে মোটা কম্বলের দুই টুকরার পরিবর্তে জান্নাতের চাদর পরিধান করাবেন। তুমি তা যেভাবে ইচ্ছে পরিধান করতে পারবে।


তার কঠিন দরিদ্রতার কারণে তিনি ছুফ্ফা বাসীদের বাসস্থানে বসবাস করতেন। তা ছিল রাসুলের ঘরের পেছনে মুহাজির গরীবদের বাসস্থান। তার বয়স তখন ২৩ বছর। তাবুক যুদ্ধের ঘোষণা আসলে তিনি রাসুল (সঃ) এর সাথে এই অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন। তারপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুলা আপনি আমার জন্য দোয়া করুন। আমার যেন শাহাদাতের মৃত্যু হয়। তখন রাসুলুল্লাহ (সঃ) দুই হাত উঠিয়ে দোয়া করতে শুরু করলেন। হে আল্লাহ! তুমি আব্দুল্লাহর রক্তকে কাফেরদের তরবারির উপরে হারাম করে দাও। আব্দুল্লাহ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো এই দোয়া চাই না। আমি তো শাহাদাত কামনা করি। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হে আব্দুল্লাহ। আল্লাহর কিছু বান্দা আছে, যারা আল্লাহর পথে বের হয় এবং রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাঁরা শহীদ। আর কিছু বান্দা আছে, যারা আল্লাহর পথে বের হয় অতঃপর ঘোড়া থেকে পড়ে মারা যায়, তারাও শহীদ। সম্ভবত তুমি জ্বর আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে শহীদ হবে। আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে তাবুক যুদ্ধে উপস্থিত হয়ে মুসলমানদের অনেক সাহায্য করেন। তাদের প্রত্যাবর্তন এর পথে আব্দুল্লাহ কঠিন জ্বর আক্রান্ত হয়। এবং মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করেন।


আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) আব্দুল্লাহ জুল বিজাদাইন এর মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করেন। আমি গভীর অন্ধকার ও কনকনে শীতের রাত্রে ঘুমিয়েছিলাম। আমার ঘুমিয়ে থাকার মধ্যে আমার তাবুর বাইরে

গর্ত খনন করার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বিস্মিত হলাম, এই অন্ধকারও ঠান্ডার মধ্যে কে গর্ত খনন করছে। আমি জাগ্রত হয়ে রাসুলুল্লাহ (সঃ), আবু বক্কর সিদ্দিক (রাঃ) এবং ওমর ফারুক (রাঃ) কে তাদের তাবুতে তালাশ করলাম। কিন্তু তাদেরকে পেলাম না। আমি বিস্মিত, হলাম তারা কোথায়। গিয়েছে। আমি বেরিয়ে পড়লাম। খোঁজ করতে করতে দেখি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ও হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) প্রদীপ ধরে রেখেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) কবর খনন করছেন। আমি তার কবর খনন করা অবস্থায় তার নিকট যে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কি হয়েছে? রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর মোবারক চেহারা আমার দিকে উঠালেন। আমি দেখতে পেলাম, তার চক্ষুদ্বয় দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি বললেন তোমার ভাই জুল বিষাদাইন (দুই টুকরা কম্বল ওয়ালা) ইন্তেকাল করেছেন। আমি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) এর দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি প্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে কবর খনন করার মত কষ্টদায়ক কাজ করতে দিচ্ছেন? তখন আবু বক্কর সিদ্দিক (রাঃ) বললেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) নিজেই আব্দুল্লাহর কবর খনন করা ছাড়া অন্য কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না।


রাসুলুল্লাহ (সাঃ) দুই হাতে জুল বিজাদাইনের কবর খনন করে সেই কররে নেমে তার দেহ মোবারক সেই কবরে শায়িত করলেন। যাতে কবরটি জুল বিজাদাইন এর জন্য অনুগ্রহের কারণ হয়। তারপর তিনি দাঁড়িয়ে তার দুই হাত হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) এর দিকে তুলে বললেন, তোমরা উভয় তোমাদের এই ভাইকে আমার নিকটে দাও। তার প্রতি দয়া-পরবশ হয়ে বললেন, আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসতো। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে দেখেছি, তিনি লাশ ধরেছেন এবং কাফনের উপর তার চোখের পানি টপটপ করে পড়ছে। তিনি চার তাকবীর দেন এবং বলেন, হে আব্দুল্লাহ। আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করুন। তুমি আল্লাহর প্রতি অনুগত ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতকারী। তারপর তিনি তাঁর মাথাকে আসমানের দিকে তুলে বললেন, হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সাক্ষী রাখছি, নিশ্চয় আমি জুল বিজাদাইন এর উপরে রাজি ও খুশি আছি। তুমি তার প্রতি রাজি-খুশি থাকো।


আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বললেন, আমি আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি আমি ঐ দিন আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম, আমি যদি এই কবরের অধিবাসী হতে পারতাম।

আল্লাহ ওই যুবকের উপর অনুগ্রহ করুন। যার সামনে দুনিয়ার সকল স্বাদ থাকা সত্ত্বেও দ্বীনের কারণে তা ত্যাগ করতে পেরেছে। আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এর সন্তুষ্টির অধিকারী হয়েছে। এবং সে আল্লাহ এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে। তার ইসলাম গ্রহনের বয়স মাত্র ৭ বছর। আমাদের মধ্যে বহু ব্যক্তিকে আব্দুল্লার জন্য দেওয়া সাত বছরের চাইতে অনেক বেশি বছর দান করবেন। আল্লাহ দেখবেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সেই সময় গুলোতেআমরা কি করবে। অতএব হে আল্লাহ তুমি আমাদের সত্যকে সত্য হিসেবে দেখিয়ে তার অনুসরণ করার তৌফিক দাও। মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে দেখিয়ে তা বর্জন করার তৌফিক দাও এবং আমাদেরকে ফেতনায় না জড়িয়ে তোমার কাছে তুলে নাও।

হযরত আবু দারদা রাঃ বর্ণিত আলেমের মর্যাদা


 

আরবীঃ

وَعَن أَبي الدَّردَاءِ قَالَ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ ﷺ يَقُولُمَنْ سَلَكَ طَرِيقاً يَبْتَغِي فِيهِ عِلْماً سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقاً إِلَى الجَنَّةِ، وَإِنَّ المَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا لِطَالِبِ العِلْمِ رِضاً بِمَا يَصْنَعُ وَإِنَّ العَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الأَرْضِ حَتَّى الحِيتَانُ فِي المَاءِ وَفَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِ القَمَرِ عَلَى سَائِرِ الكَوَاكِبِ وَإِنَّ العُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَاراً وَلاَ دِرْهَماً وَإِنَّمَا وَرَّثُوا العِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بحَظٍّ وَافِرٍرواه أَبُو داود والترمذي

অনুবাদঃ

আবূ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে, যাতে সে জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। আর ফেরেশতাবর্গ তালেবে ইলমের জন্য তার কাজে প্রসন্ন হয়ে নিজেদের ডানাগুলি বিছিয়ে দেন। অবশ্যই আলেম ব্যক্তির জন্য আকাশ-পৃথিবীর সকল বাসিন্দা এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। আবেদের উপর আলেমের ফযীলত ঠিক তেমনি, যেমন সমস্ত নক্ষত্রপুঞ্জের উপর পূর্ণিমার চাঁদের ফযীলত। উলামা সম্প্রদায় পয়গম্বরদের উত্তরাধিকারী। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, পয়গম্বরগণ কোন রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রার কাউকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে যাননি; বরং তাঁরা ইলমের (দ্বীনী জ্ঞানভান্ডারের) উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করল, সে পর্যাপ্ত অংশ লাভ করল।

[গ্রন্থ সুত্রঃ জামি আত তিরমিযী- ২৬৮২, সুনানু ইবনে মাজাহ- ২২৩, হাদীস শরীফ; ১ম খন্ড]

রাবী পরিচিতিঃ

নাম : ওয়াইমির।

উপনাম : আবু দারদা।

উপাধি : হাকীমুল উম্মাহ৷

স্ত্রীর নাম : খায়রা । যিনি উম্মে দারদা নামে প্রসিদ্ধ।

আবু দারদার মেয়ের নাম দারদা। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী সন্তানের নামানুসারে আবু দারদা ও উম্মে দারদা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আবু দারদা ছিলেন মদীনার খাযরাজ গোত্রের বিশিষ্ট আনসারী সাহাবী।

কর্মজীবন : আড়ম্বরহীন জীবনের অধিকারী এই মহান সাহাবী উত্তম চরিত্র, দয়া, অতিথিপরায়ণতা, মানবহিতৈষী প্রভৃতি সৎগুণের আধার ছিলেন। ফেকহ ও হাদীস শাস্ত্রে তাঁর গভীর পাণ্ডিত্ব ছিল । রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও তাঁর দক্ষতা ছিল বেশ। হযরত ওমর ও হযরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার শাসনামলে তিনি সিরিয়ার গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছিলেন। হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কোথাও সফর করার সময় তাঁকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়ার বিচারপতি হয়েছিলেন।

তাঁর বর্ণিত হাদীস সংখ্যা : হযরত আবুদ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাস থেকে ১৭৯ টি হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন। ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বুখারীতে ১৩টি হাদীস এবং ইমাম মুসলিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুসলিম শরীফে ৮টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। “যাখায়িরুল মাওয়ারিস” নামক গ্রন্থে আবুদ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত হাদীসসমূহ সংকলিত করা হয়েছে।

মৃত্যু : জীবনের শেষের দিকে তিনি সিরিয়ায় বসবাস করতেন। সেখানেই তিনি হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের শেষ সময়ে ৩২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

গ্রন্থ পরিচিতঃ

জামি আত তিরমিযীঃ

জামি তিরমিযী তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযােগ্য গ্রন্থ। ইমাম তিরমিযী তাঁর এ গ্রন্থ খানা ইমাম আবু দাঊদ ও ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর অনুসৃত গ্রন্থ প্রণয়নরীতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রথমত এতে ফিকহের অনুরূপ অধ্যায় রচনা করা হয়েছে। এতে ব্যবহারিক জীবনের প্রয়ােজনীয় হাদীস সমূহ সন্নিবেশিত করেছেন। সে সঙ্গে বুখারীর ন্যায় জীবন চরিত, শিষ্টাচার, তাফসীর, আকীদা-বিশ্বাস, বিশৃংখলা, বিপর্যয়, আহকাম, যুদ্ধ-সন্ধি, প্রশংসা ও মর্যাদা ইত্যাদি বিষয়ের হাদীসও সংযােজিত করেছেন। ফলে গ্রন্থখানি এক অপূর্ব সমন্বয়, এক ব্যাপক গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। এ কারণে এ গ্রন্থের ‘জামি’ নাম সার্থক হয়েছে।

ইমাম তিরমিযী এতে বিভিন্ন বিষয়ের অতি প্রয়ােজনীয় হাদীস সমূহ সুন্দরভাবে সজ্জিত করেছেন। এজন্য হাফিয আবু জাফর ইবনু যুবাই ‘কুতুবুস সিত্তাহ’ সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, والترمذي في فنون الصناعة الحديثية مالم يشاركه غيره ‘ইমাম তিরমিযী ইলমে হাদীসে গ্রন্থ প্রণয়নের ক্ষেত্রে অবিসংবাদিত”। ইমাম তিরমিযী তার এ গ্রন্থ প্রণয়ন সমাপ্ত করে তদানীন্তন মুসলিম জাহানের হাদীসবেত্তাগণের নিকট এটা যাচাই করার জন্য পেশ করেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, صفت هذا المسند الصحيح وعرضته على علماء الحجاز قرضوا به وعرضه على علماء خراسان فرضوا به‘আমি এ সনদযুক্ত হাদীছ গ্রন্থখানি প্রণয়ন করে একে হিজাযের হাদীসবিদদের সমীপে পেশ করলাম। তারা এটা দেখে খুবই পছন্দ করলেন ও সন্তোষ প্রকাশ করলেন। এরপর আমি এ গ্রন্থকে খুরাসানের মুহাদ্দিসগণের খেদমতে পেশ করলাম। তারাও একে অত্যন্ত পছন্দ করেন এবং সন্তোষ প্রকাশ করেন’।

ইমাম তিরমিযী তার সংগৃহীত পাঁচ লক্ষ হাদীসের মধ্য হতে মাত্র ১৬০০ হাদীছ নির্বাচন করে ‘জামে তিরমিযী’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এতে ৪৬টি পর্ব এবং ২১১৪টি অধ্যায় আছে।

সুনানু ইবনে মাজাহঃ

ইমাম ইবনে মাজাহ (রহঃ) -এর দীর্ঘদিনের কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়ের ফসল সুনানু ইবনে মাজাহ। এটি সিহাহ সিত্তার অন্যতম গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি সংকলন শেষে ইমাম ইবনু মাজাহ (রহঃ) স্বীয় প্রখ্যাত উস্তাদ ইমাম আবু যুর আর-রাযীর নিকট পেশ করলে তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণপূর্বক একে ইলমে হাদীসের এক অনন্য সাধারণ ও উপকারী গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি দেন। এ সম্পর্কে ইমাম ইবনু মাজাহ (রহঃ) বলেন, عرضت هذه السنن على أبي زرعة فنظر فيه، وقال: أظن إن وقع هذا في أيدي الناس تعطلت هذه الجوامع أو أكثر هاء

‘আমি এ সুনান গ্রন্থটির সংকলনকার্য সমাপনান্তে আমার উস্তাদ আবু মুর’আ আর-রাযীর নিকট পেশ করলে তিনি সূক্ষভাবে নিরীক্ষাপূর্বক মন্তব্য করেন যে, আমি মনে করি এ সুনাল গ্রন্থটি জনসাধারণের হাতে পৌঁছলে বর্তমান পর্যন্ত সংকলিত সবগুলাে অথবা অধিকাংশ হাদীসগ্রন্থ অগ্ৰযােজনীয় হয়ে যাবে।

ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ:) লক্ষাধিক হাদীস যাচাই-বাছাই করে এ গ্রন্থটিতে মােট ৪৩৪১ টি হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। এর মধ্যকার ৩০০২ টি হাদীস এমন যেগুলাে পাঁচটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের সবগুলােতে অথবা কোন কোনটিতে রয়েছে। এছাড়া ১৩৩১ টি হাদীছ ব্যতিক্রম। যেগুলাে সিহাহ সিত্তার অন্য পাঁচজন গ্রন্থকার বর্ণনা করেননি। এতে মােট ৩৭ টি অধ্যায় ও ১৫৪৫ টি পরিচ্ছেদ রয়েছে।  হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, وثلاثين كتابا، وألف وخمسمائة باب، و على أربعة آلاف حديث ويشتمل على اثنين “এতে ৩২ টি অধ্যায়, ১৫০০ টি পরিচ্ছেদ এবং চার সহস্রাধিক হাদীস রয়েছে’। 

হাদীসের ব্যাখ্যা:

দ্বীনী ইলম শিক্ষার গুরুত্ব :

ইসলামে জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। এ গুরুত্বের কারণেই আল্লাহ তা‘আলা প্রথম মানুষ আদি পিতা আদম (আঃ)-কে সর্বপ্রথম শিক্ষাদান করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلاَئِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُوْنِيْ بِأَسْمَاءِ هَـؤُلاَءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ- ‘আর আল্লাহ আদমকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দোন। তারপর সেসমস্ত বস্ত্ত ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। অতঃপর আল্লাহ বলেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক’ (বাক্বারাহ ৩১)। জ্ঞানই সবকিছুর ভিত্তিমূল। জ্ঞানের আলোকেই মানুষ ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে। জ্ঞান তথা শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই রচিত হয় জাতিসত্তা। কোন জাতির সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হ’ল শিক্ষা। জাতীয় আশা-আকাঙ্খা পূরণ, জাতীয় আদর্শের ভিত্তিতে চরিত্র গঠন, জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও বিভাগে নেতৃত্বদানের উপযোগী ব্যক্তিত্ব তৈরি করা কেবলমাত্র উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই সম্ভব। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রধান উপকরণও শিক্ষা।

কোন জাতিকে একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হ’লে সেই জাতির লোকদেরকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। যখন তারা সেই আদর্শ অনুযায়ী তৈরি হবে তখনই একটি সফল সামাজিক বিপ্লব সাধন সম্ভব। মহানবী (ছাঃ) মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে জাহেলিয়াতের গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন জাতিকে একটি বিশ্ববিজয়ী জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। আর এজন্য তিনি হেরা পর্বতের চূড়া থেকে নেমে আসা ইসলামের সর্বপ্রথম বাণী ‘ইক্বরা’র পথ ধরেই সামনে অগ্রসর হয়েছিলেন।

প্রথম ওহী ‘পড়ুন’ :

* اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَق

পড়ো তোমার প্রভূর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন ।

অর্থাৎ, ইসলাম ধর্মের আগমনে পৃথিবীবাসী মানুষের জন্য জাগতিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার শিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত হয়েছে। ইসলামের তথা, আল কুরআনের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত বাণীটিই হচ্ছে- اقرأ অর্থাৎ, পড়ুন। এখান থেকে অনুধাবন করা যায়, ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য জ্ঞানের দ্বার কিভাবে উম্মুক্ত করে দিয়েছে। নিম্নে আলেমদের মর্যাদা বিস্তারিত তুলে ধরা হলোঃ

(১) আলেম ও জাহেলের মধ্যে পার্থক্য : ইলম আল্লাহ প্রদত্ত এক অফুরন্ত নেয়ামত। যা জ্ঞানী ও মূর্খদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ ‘বলুন! যারা জানে এবং যারা জানে না তার কি সমান?’ (যুমার ৩৯/৯)। তিনি অন্যত্র বলেন, قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ ‘বলুন! অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হ’তে পারে? আলো ও অন্ধকার কি এক হ’তে পারে?’ (রা‘দ ১৩/১৬)

(২) আলেমগণ নবীদের উত্তরাধিকারী : নবী-রাসূলগণ মানব সমাজের সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী সর্বোত্তম মানুষ। তাই আলেমদের সবচেয়ে বড় মর্যাদা হ’ল, রাসূল (সাঃ) তাঁদেরকে নবীগণের উত্তরাধিকারী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন রাসূল (সাঃ) বলেন, إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا، وَلَا دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ، ‘আলেমগণ নবীগণের উত্তরাধিকারী। নবীগণ দীনার বা দিরহামকে উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান না। বরং তারা রেখে গেছেন কেবল ইলম। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’। [ইবনু মাজাহ ২/২২৩; তিরমিযী হা/২৬০৬]

(৩) আলেমগণ দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও প্রভূত কল্যাণের অধিকারী : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّيْنِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন’।[বুখারী হা/৭১]  অতএব মহান আল্লাহ যার কল্যাণ চান, যাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করতে চান, তাঁকেই কেবল তিনি আলেম হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন।

আল্লাহ বলেন,يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ أُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)

তিনি আরো বলেন, يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে উক্ত প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। বস্তুতঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ ব্যতীত কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)

(৪) প্রকৃত আলেমের জন্য জান্নাতের পথ সহজ হয়ে যায় : আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, اَلْخَلْقُ كُلُّهُمْ يُصَلُّونَ على مُعَلِّمِ الخَيْرِ حَتَّى حِيْتَانِ البَحْرِ ‘মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীর জন্য সমগ্র সৃষ্টি, এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্তও তার জন্য দো‘আ করে’। [সিলসিলা ছহীহাহ: ১৮৫২]

(৫) আলেমের মর্যাদা আবেদের চেয়ে বেশী : রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ ‘আলেমগণের মর্যাদা আবেদগণের উপরে ঐরূপ, পূর্ণিমার রাতে চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকাসমূহের উপরে যেরূপ’। [মিশকাত হা/২১২]

ক্বাযী আয়ায বলেন, এই তুলনার কারণ এই যে, নক্ষত্রের আলো দ্বারা সে কেবল নিজেই আলোকিত হয়। কিন্তু চাঁদের আলো নিজেকে ছাড়াও অন্যকে আলোকিত করে। অনুরূপভাবে আবেদ তার ইবাদত দ্বারা কেবল নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়। কিন্তু আলেম তার ইল্ম দ্বারা নিজে যেমন উপকৃত হন, তেমনি অন্যকে উপকৃত করে থাকেন। আলেম উক্ত নূর লাভ করেন রাসূল (সাঃ) থেকে। যেমন চন্দ্র জ্যোতি লাভ করে থাকে সূর্য থেকে। আর সূর্য কিরণ লাভ করে আল্লাহ থেকে। একইভাবে রাসূল (সাঃ) ‘অহি’ লাভ করে থাকেন আল্লাহ থেকে’ (মিরক্বাত)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَصْدٌ فِي عِلْمٍ خَيْرٌ مِنْ فَضْلٍ فِي عِبَادَةٍ ‘অধিক ইবাদত করার চেয়ে অধিক ইলম অর্জন করা উত্তম। [মিশকাত হা/২৫৫]

আবূ উমামা বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসূল (সাঃ) এর সামনে দু’জন লোকের কথা উল্লেখ করা হ’ল। যাদের একজন আলেম অপরজন আবেদ। তখন তিনি বলেন, فَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ ‘আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর। যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের সাধারণের উপর’। [তিরমিযী হা/২৬৮৫]

(৬) ইলম বিতরণকারী আমলকারীর সমপরিমাণ নেকী লাভ করবেন : একজন আলেম লেখনী, শিক্ষাদান বা বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। ফলে যত মানুষ তার মাধ্যমে হেদায়াত লাভ করবে, নেকীর কাজের দিশা পাবে এবং তদনুযায়ী আমল করে সওয়াব অর্জন করবে, উক্ত আলেম তাদের সমপরিমাণ নেকী লাভে ধন্য হবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ عَلَّمَ عِلْمًا فَلَهُ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهِ، لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الْعَامِلِ ‘যে ব্যক্তি দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিবে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় ছওয়াব পাবে, যে তার উপর আমল করবে। তবে আমলকারীর ছওয়াব থেকে সামান্যতমও কমানো হবে না’। [ইবনু মাজাহ হা/২৪০]

এমনকি মৃত্যুর পরেও তিনি উক্ত নেকী লাভ করতে থাকবেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ: إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ، ‘মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তিনটি আমল ব্যতীত তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। ১. প্রবাহমান দান ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং ৩. নেক সন্তান, যে তার জন্য দো‘আ করে’। [মুসলিম হা/১৬৩১]

আলেমে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য: নিম্নে ওলামায়ে কেরামের উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হ’ল।-

(১) আল্লাহভীরু হওয়া : একজন আলেমের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হ’ল তিনি আল্লাহভীরু হবেন। আল্লাহভীতি ছাড়া পাহাড় পরিমাণ জ্ঞান কোনই কাজে আসবে না। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে মূলতঃ আলেমরাই তাঁকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)। আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন,لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ ‘অধিক হাদীছ জানাই প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়। বরং প্রকৃত জ্ঞানার্জন হ’ল আল্লাহভীতি অর্জন করা। [ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ, ১৪৭ পৃঃ]

জনৈক আরবী কবি বলেন,لو كان للعلم شرف من دون التقي* لكان أشرف خلق الله إبليس ‘যদি তাক্বওয়াবিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত, তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হতো। [মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী, ১/১৩]

জ্ঞানের অহংকার সবচেয়ে বড় অহংকার। তাই তাক্বওয়া বিহীন ইলম ব্যক্তির আত্মগরিমাকে পরিপুষ্ট করে। ফলে ঐ ইলম তার ক্ষতির কারণ হয়। অন্যদিকে তাক্বওয়াশীল আলেম সর্বদা বিনয়ী হন। ফৎওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে তারা কখনো সর্বজান্তা ভাব প্রকাশ করেন না। বরং প্রতিটি আমলের ব্যাপারে, প্রতিটি ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন। ভুল হয়ে যাওয়ার ভয়ে সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকেন। তাই দেখা যায় যে ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ) বিশ্ববিশ্রুত ইমাম হওয়া সত্বেও তাঁকে ৪৮টি প্রশ্ন করা হলে ৩২টির জবাবে তিনি বলেন, لاَ أدْرِيْ ‘আমি জানি না’। [কুরতুবী, বাক্বারাহ ৩২ আয়াতের তাফসীর]

(২) দ্বীনের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা : আলেমে দ্বীনের দায়িত্ব হ’ল মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত প্রদানের পূর্বে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান আহরণ করা। ইমাম বুখারী (রহঃ) ছহীহ বুখারীতে ‘কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান অর্জন করা’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন।[বুখারী পৃঃ ১৬]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,مَنْ عَلِمَ فَلْيَقُلْ، وَمَنْ لَمْ يَعْلَمْ فَلْيَقُلِ اللهُ أَعْلَمُ. فَإِنَّ مِنَ الْعِلْمِ أَنْ يَقُولَ لِمَا لاَ يَعْلَمُ لاَ أَعْلَمُ ‘যে জানে সে যেন তাই বলে, আর যে জানে না সে যেন বলে, আল্লাহ সর্বাধিক অবগত। কারণ এটাও একটা জ্ঞান যে, যার যে বিষয় জানা নেই সে বলবে, আমি এ বিষয়ে জানি না। [বুখারী হা/৪৭৭৪; মুসলিম হা/২৭৯৮]

ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ) বলেন, مَن قال لاَ أدْرِيْ فقد أحرز نصفَ العلم ‘যে বলবে, আমি জানি না। সে অর্ধেক জ্ঞান অর্জন করল’। [আল-বায়ান ওয়াত তাবয়ীন, ১/৩১৪]

(৩) কুরআন ও ছহীহ হাদীসের সিদ্ধান্তের নিরঙ্কুশ অনুসরণ :

আল্লাহ বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا، ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি আরো বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُبِيْنًا- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)

অন্যত্র তিনি বলেন,فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا- ‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)

আলেমে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সহীহ হাদীস পেলেই তা গ্রহণ করা। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বলেন, إذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ، ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, যেনো সেটাই আমার মাযহাব’। [ইবনু আবেদীন, রাদ্দুল মুহতার ১/১৬৭] সাথে সাথে সকল প্রকার যঈফ ও জাল হাদীছ   থেকে সর্বোতভাবে দূরে থাকা। কারণ রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি আমার উপর ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যারোপ করল, সে তার নিজের স্থান জাহান্নামে করে নিল’। [বুখারী হা/৬১৯৭]

(৪) নবী-রাসূলগণের দাওয়াতী নীতি অনুসরণ করা : আলেমে দ্বীনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’ল দাওয়াতের ক্ষেত্রে নবী-রাসূলগণের নীতি অনুসরণ করা। নবী-রাসূলগণ মূলতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিরক বিমুক্ত তাওহীদ বিশ্বাস ও বিদ‘আতমুক্ত আমলের দিকে মানুষকে আহবান করেছেন। আলেমগণ মানুষকে সেদিকেই আহবান করবেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوْتَ- ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকটে আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ ‘আর আমরা তোমার পূর্বে কোন রাসূল প্রেরণ করিনি এই অহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা আমার ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/৮২৫)

মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামনে প্রেরণকালে রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, ‘তুমি আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের নিকটে যাচ্ছ। সুতরাং প্রথমে তাদেরকে এই সাক্ষ্য প্রদানের দাওয়াত দিবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন মা‘বূদ নেই এবং আমি তাঁর রাসূল। যদি তারা তোমার এ দাওয়াত মেনে নেয় তাহ’লে তাদেরকে বলবে যে, আল্লাহ দিন-রাতে তাদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যদি তারা তোমার একথাও মেনে নেয়, তখন তাদের জানিয়ে দিবে যে, আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনীদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হবে’। [বুখারী হা/১৪৫৮; মুসলিম হা/১৯]

(৫) সালাফে সালেহীনের পদাংক অনুসরণ করা : দ্বীনী বিধি-বিধান সাব্যস্তের ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরামকে সালাফগণের অনুসরণ করতে হবে। তথা শারঈ কোন বিষয়ে জানা ও বোঝার জন্য কুরআন ও ছহীহ হাদীসকে সামনে রাখার সাথে সাথে সাহাবায়ে কেরাম কিভাবে সেটি ব্যাখ্যা করেছেন এবং কিভাবে বুঝেছেন তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

কারণ সাহাবায়ে কেরাম শারঈ বিধি-বিধান সরাসরি রাসূল (ছাঃ) থেকে গ্রহণ করেছেন, যথাযথভাবে অনুধাবন করেছেন এবং নিজেদের জীবনে তা বাস্তবায়ন করেছেন। তারাই রাসূল (সাঃ)-এর পর উম্মতে মুহাম্মাদীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। ইমরান বিন হুছাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, خَيْرُ أُمَّتِىْ قَرْنِىْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ثُمَّ الَّذِيْنَ يَلُوْنَهُمْ ‘আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ হ’ল আমার যুগের লোক (অর্থাৎ ছাহাবীগণ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবেঈগণ)। অতঃপর তৎপরবর্তী যুগের লোক (অর্থাৎ তাবে তাবেঈন)। [বুখারী হা/৩৬৫০; মুসলিম হা/২৫৩৩]

(৬) ইখলাস বজায় রাখা : আলেম দ্বীনের সকল কর্ম সকল ইবাদত হবে ইখলাছপূর্ণ। কারণ ইখলাছবিহীন কোন আমল আল্লাহ কবুল করেন না। আল্লাহ বলেন,قُلْ إِنِّيْ أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّيْنَ، ‘বল, আমি আদিষ্ট হয়েছি, যেন আমি আল্লাহর ইবাদত করি একনিষ্ঠভাবে তাঁর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য সহকারে’ (যুমার ৩৯/১১)

রাসূল (সাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ لَا يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلَّا مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার জন্য একনিষ্ঠভাবে সম্পাদিত ও তার সন্তুষ্টি কামনায় নিবেদিত আমল বৈ কবুল করেন না। [নাসাঈ হা/৩১৪০]

অতএব দ্বীনী ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে পূর্ণ ইখলাস বজায় রাখা আবশ্যক। কেউ যদি দুনিয়াবী কোন স্বার্থসিদ্ধি বা সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনের জন্য ইলম অন্বেষণ করে, তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوْهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ، ‘যে ব্যক্তি আলেমদের উপর গৌরব করার জন্য অথবা মূর্খদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার জন্য অথবা মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন’। [তিরমিযী হা/২৬৫৪]

তিনি বলেন,مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيْبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ‘যে ইলম বা জ্ঞান দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, কেউ সে জ্ঞান পার্থিব স্বার্থোদ্ধারের অভিপ্রায়ে অর্জন করলে ক্বিয়ামতের দিন সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’। [আহমাদ ৮২৫২]

(৭) ইলম অনুযায়ী আমল করা : ইলম অনুযায়ী আমল করা একজন আলেমের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ তারা মানুষকে সৎ পথের দিকে আহবান করেন এবং অসৎকর্ম থেকে নিষেধ করেন। এক্ষণে তারা যদি নিজেরাই তা পালন না করেন, তবে তাদের পরিণতি কত ভয়াবহ হ’তে পারে তা রাসূল (ছাঃ)-এর একটি হাদীছ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। যেখানে তিনি বলেছেন, ক্বিয়ামতের দিন জনৈক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আগুনে তার নাড়ী-ভূড়ি বেরিয়ে যাবে। তখন সে ঐ নাড়ী-ভূড়ির চতুর্দিকে ঘুরতে থাকবে। যেমনভাবে গাধা ঘানির চারদিকে ঘুরে থাকে। এ অবস্থা দেখে জাহান্নামবাসীরা তার চার পাশে জড়ো হবে ও তাকে লক্ষ্য করে বলবে, হে অমুক! তোমার এ কি অবস্থা? তুমি না সর্বদা আমাদেরকে ভাল কাজের উপদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতে? তখন লোকটি জবাবে বলবে, আমি তোমাদেরকে ভাল কাজের আদেশ দিতাম; কিন্তু নিজে তা করতাম না। আমি তোমাদেরকে মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করতাম; কিন্তু আমি নিজেই সে কাজ করতাম। [মিশকাত হা/৫১৩৯]

সাহল ইবনু আব্দুল্লাহ বলেন, যখন কোন মুমিন তার ইলম অনুযায়ী আমল করবে, তখন তার ইলম তাকে তাক্বওয়া ও পরহেযগারিতার দিকে পথ প্রদর্শন করবে। আর যখন সে তাক্বওয়া অবলম্বন করবে, তখন তার অন্তর আল্লাহ রাববুল আলামীনের সাথে যুক্ত হবে। [হিলয়াতুল আউলিয়া ১০/২০৫]

(৮) হকের উপর অবিচল থাকা : আল্লাহ বলেন,الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلاَ تَكُنْ مِنَ الْمُمْتَرِينَ ‘সত্য কেবল তোমার পালনকর্তার পক্ষ হ’তে আসে। অতএব তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/৬০)। আলেমে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য হ’ল হকের উপর অটল থাকা। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপর বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না, এমতাবস্থায় ক্বিয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ঐভাবে থাকবে’। [মুসলিম হা/১৯২০]

(৯) উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া : আলেমগণ সর্বসাধারণের জন্য আদর্শ মানুষ হিসাবে গণ্য হন। তাই একজন আলেমের জন্য উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া আবশ্যক। সেকারণ আল্লাহ  রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা উত্তম যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম’। [বুখারী হা/৩৫৫৯]

আলেমদের কখনোই কর্কশভাষী, অশ্লীলভাষী, বদমেজাজী হওয়া চলবে না। সেকারণ আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় নবী (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيْظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوْا مِنْ حَوْلِكَ ‘আপনি যদি কর্কশভাষী, কঠোর হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার সংসর্গ হতে দূরে সরে যেত (আলে ইমরান ১৫৯)

রাসুল (সাঃ) বলেন, إِنَّ أَثْقَلَ شَيْءٍ يُوْضَعُ فِىْ مِيْزَانِ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ خُلُقٌ حَسَنٌ وَإِنَّ اللهَ يُبْغِضُ الْفَاحِشَ الْبَذِيءَ ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের পাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে আমলটি রাখা হবে তা হ’ল উত্তম চরিত্র। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ অশ্লীলভাষী দুশ্চরিত্র ব্যক্তিকে ঘৃণা করেন। [তিরমিযী হা/২০০২]

জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-কে বললেন, আমাকে নছীহত করুন। তিনি বললেন, لاَ تَغْضَبْ ‘তুমি রাগ কর না’। তিনি কয়েকবার একথাটি বললেন। [বুখারী হা/৬১১৬]

(১০) সহনশীল হওয়া : ওলামায়ে দ্বীনকে অবশ্যই ধৈর্যশীল, সহনশীল ও ঠান্ডা মাথার অধিকারী হ’তে হবে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূল (ছাঃ) আব্দুল কায়েস গোত্রের নেতা, আশাজ্জ মুনযির ইবনু আয়েযকে বললেন,إِنَّ فِيْكَ خَصْلَتَيْنِ يُحِبُّهُمَا اللهُ الْحِلْمُ وَالأَنَاةُ، ‘তোমাদের মধ্যে এমন দু’টি ভাল গুণ রয়েছে, যাকে আল্লাহ পসন্দ করেন। তা হ’ল সহনশীলতা ও ধীর-স্থিরতা’। [মিশকাত হা/৫০৫৪]

(১১) লজ্জাশীল ও নম্র হওয়া : ইমরান বিন হুছায়েন (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الْحَيَاءُ لاَ يَأْتِى إِلاَّ بِخَيْرٍ ‘লজ্জা কল্যাণ বৈ কিছুই আনয়ন করে না’। তিনি বলেন, مَنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ ‘যাকে কোমলতা ও নম্রতা হ’তে বঞ্চিত করা হয়, তাকে যাবতীয় কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করা হয়’। [মুসলিম হা/২৫৯২]

(১২) নিজের বিরুদ্ধে হলেও সর্বদা হক কথা বলা : আলেমগণ সর্বদা হকের পথের দিশারী হবেন। যেমন কোন বক্তব্য বা ফৎওয়া প্রদানের পর পরবর্তীতে যদি তা ভুল প্রমাণিত হয়, তবে তা থেকে ফিরে আসা এবং ভুল স্বীকার করে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান একজন আলেমের জন্য আবশ্যক। এক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার জন্য ইলম গোপন করা, জেনেশুনে ভুল ফৎওয়া প্রদান করা চরম অন্যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ يَعْلَمُهُ فَكَتَمَهُ أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ، ‘কাউকে তার জ্ঞাত কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে যদি সে তা গোপন রাখে, ক্বিয়ামতের দিন তার মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেওয়া হবে’। [আহমাদ ২/৭৮৮৩]

শিক্ষাঃ

১. আলেমদের মর্যাদা অনেক বেশি যদি তারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান অর্জন করে।
২. আলেমরা নবীদের উত্তরসূরী তাই তাতের উচিত প্রচলিত জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত মানুষদের জান্নাতমুখী করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো।
৩. পৃথিবীর কোন লোভ লালসায় আলেমদের আকৃষ্ট হওয়া উচিত নয়। এতে করে তাদের জবাবদিহিতা কিয়ামতেরদিন অত্যন্ত কঠিন হবে।

 

সর্বশেষ পোস্ট

যুগে যুগে ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস

ভূমিকা: ইসলামী আন্দোলন শুধু যুগ যুগ ধরে নয়। এ আন্দোলন শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে। এ আন্দোলন হাজার বছরের আন্দোলন। ঈসা আঃ এর আগমনের প্রায় ৬০০ বছ...

জনপ্রিয় পোস্ট